শনিবার, সেপ্টেম্বর ২১, ২০১৩

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাতাসে উড়ছে নিয়োগ বানিজ্যের টাকা

ক্যাম্পাস অচলের আশংকা


বিশেষ প্রতিনিধি, ইবি : বসন্তের ঝরা পাতার ন্যায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) বাতাসে উড়ছে নিয়োগ বাণিজ্যের টাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন্ন সিন্ডিকেট সভার নিয়োগকে উপলক্ষ্য করে প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা এখন বাতাসে ওড়া সে টাকা ধরতে ব্যস্ত। বাণিজ্যে পিছিয়ে নেই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও। গত বছরের ৭ ও ৮ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত নিয়োগের সিন্ডিকেটে গণ নিয়োগকে কেন্দ্র করে ছয় মাস অচল ছিলো বিশ্ববিদ্যালয়টি। ফলে দূর্নীতি বিরোধী শিক্ষক-ছাত্রদের সর্বাত্মক আন্দোলনে পদচ্ছুত হয়েছে ভিসি, প্রো-ভিসি, ট্রেজারার, প্রক্টর ও ছাত্রউপদেষ্টা। নতুন প্রশাসনও একই পথে হাঁটার কারনে সরকারের শেষ সময়ে এসে আবারো অচলাবস্থার দিকে যাচ্ছে ক্যাম্পাস। এনিয়ে রীতিমত ক্ষুব্ধ ও শঙ্কিত সাধারণ শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।সূত্র মতে- চলতি মাসের শেষের দিকে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১৮তম সিন্ডিকেটের সভা অনুষ্ঠিত হবে। এই সভাকে কেন্দ্র করে প্রশাসনের সর্বস্তরে চলছে নিয়োগের তোড়জোড়। ইতোমধ্যে ৫টি বিভাগের শিক্ষক নিয়োগের নির্বাচনী বোর্ড অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসকল বিভাগের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে কেবল অস্থায়ী শিক্ষকদের স্থায়ী করার কথা থাকলেও নিয়ম বর্হিভূত ভাবে কম্পিউটার সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ৬ জন, ইনফরমেশন এন্ড কমিউনিকেশ ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ২ জন, বায়োটেকনোলজি এন্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ৪ জন, বাংলা বিভাগে ৪ জন নতুন শিক্ষক নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিভাগের শিক্ষক নিয়োগের নির্বাচনী বোর্ড অনুষ্ঠিত হলেও বোর্ডের সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখা হয়েছে। নির্বাচনী বোর্ডে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার প্রফেসর ড. আফজাল হোসেনের পছন্দের প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিভাগের চেয়ারম্যান ও এক্সপার্ট অবস্থান নেওয়ায় বোর্ডটির সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখা হয়। ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিভাগের ওই বোর্ডে ট্রেজারার মোটা অংকের ঘুষের বিনিময়ে ইভিনিং থেকে মার্স্টাস পাশ করা পঞ্চাশউধর্ক্ষ বয়সের চরম অযোগ্য ও বিতর্কীত একজন প্রার্থীর পক্ষাবলম্বন করেন বলে জানা গেছে ।আগামী কয়েক দিনের মধ্যে পরিসংখ্যান বিভাগ, আইন ও মুসলিম বিধান বিভাগসহ কয়েকটি বিভাগের শিক্ষক নিয়োগের নির্বাচনী বোর্ড অনুষ্ঠিত হবে। এসকল নির্বাচনী বোর্ডে শিক্ষক নিয়োগের জন্য মোটা অংকের আর্থিক লেনদেন হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাব্যাক্তিদের ৫ থেকে ১৫ লক্ষ টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে অযোগ্য ও দূর্বল একাডেমিক রেজাল্টধারীরা শিক্ষক হচ্ছেন বলে শুনা যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে টাকার কাছে হার মেনেছে দলীয় আদর্শের মেধাবী প্রার্থীও। ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিভাগের শিক্ষক আসাদুজ্জামান চাকরি দেওয়ার কথা বলে ৫ লক্ষ টাকা ঘুষ নিয়েছেন বলে এক প্রার্থী ভিসির নিকট লিখিত অভিযোগও করেছেন। বাংলা বিভাগে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে চারটি প্রথম শ্রেনী প্রাপ্ত প্রার্থীকে বাদ দিয়ে অযোগ্য ও দূর্বল রেজাল্টধারী ৪ জনকে শিক্ষক নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে বলে খোদ ওই বিভাগের ১০ জন শিক্ষক সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করেছেন। এ সবগুলো বিভাগেই নতুন নিয়োগের কোন সার্কুলার না দিয়েই অবৈধ ভাবে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। বিভাগগুলোতে অস্থায়ী শিক্ষকদের স্থায়ী করা হবে মর্মে সার্কুলার দেওয়া হয়েছিলো। নতুন শিক্ষক নিয়োগের জন্য বিভাগের প্লানিং কমিটির মতামত ছাড়াই এসকল শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষা ছুটিতে থাকা সিনিয়র শিক্ষকদের বিপরীতে নতুন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। যা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কর্তৃক সম্পুর্ন নিয়ম বর্হিভূত। বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাইফুজ্জামানের বিপরীতে নতুন একজনকে প্রভাষক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। শিক্ষা ছুটিতে থাকা ওই শিক্ষক ফিরে আসলে তার কি হবে এই প্রশ্ন তুলেছেন বাংলা বিভাগের সিনিয়র শিক্ষকরা। ইনফরমশেন এন্ড কমিউনিকেশ ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, বায়োটেকনোলজি এন্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ ও ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিভাগে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রেও মোটা অংকের লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে। এসকল বিভাগে মেধাবী শিক্ষার্থীদের বাদ দিয়ে অযোগ্য ও একাডেমিক রেজাল্টের দিক থেকে দুর্বল প্রার্থীদের নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কোটায় উচ্চমান ও নিম্মমান সহকারীর ১১টি পদে নিয়োগের জন্য গত ডিসেম্বরে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছিলো। এসকল পদের নিয়োগ বোর্ড ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কোটায় চাকুরি পাওয়ার জন্য ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সুপারিশ ও মোটা অংকের টাকা দিয়ে অনেক ভূয়া মুক্তিযোদ্ধার সন্তানও আবেদন করেছেন বলে জানা গেছে। ১১টি পদের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হলেও মোটা অংকের লেনদেনের মাধ্যমে গণ নিয়োগ দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে বলে খোদ নিয়োগ বোর্ডের একাধিক সদস্য অভিযোগ করেছেন। জাতির সিংহ শার্দূল মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কোটায় চাকরি প্রার্থীদের কাছ থেকেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও ছাত্রলীগ জন প্রতি ৩ থেকে ৭ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঘুষ নিয়েছেন অভিযোগ ওঠেছে।গত জুলাই মাসে কর্মকর্তা, উচ্চমান সহকারীর ৯টি পদে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। আগামী ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে এ পদগুলোর বিপরীতে আবেদনকারী প্রার্থীদের বোর্ড অনুষ্ঠিত হবে। মূলত: ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদেরকে নিয়োগ দেওয়ার জন্য এই বিজ্ঞপ্তিটি প্রকাশ করা হলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা ইতোমধ্যে অর্ধ কোটি টাকা প্রার্থীদের কাছ থেকে গ্রহণ করেছেন বলে ছাত্রলীগ নেতারা অভিযোগ করেছেন। নিয়োগ বাণিজ্যের এই অসম প্রতিযোগীতায় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ঠাঁই হবে কি না তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের আত্মীয় স্বজন ও প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের স্ত্রী-সন্তানদেরকেও নিয়োগ দেওয়ার পায়তারা চলছে বলে জানা গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. আব্দুল হাকিম সরকার, ট্রেজারার প্রফেসর ড. আফজাল হোসেন, ভিসি অফিসের কয়েক কর্মকর্তা এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগের চেয়ারম্যানসহ দুর্নীতি পরায়ন কিছু শিক্ষককে নিয়ে গড়ে ওঠা বাণিজ্যের সিন্ডিকেট কোটি টাকা বাণিজ্য করেছেন বলে শিক্ষক সমিতি অভিযোগ তুলেছেন। একাধিক সূত্রে অভিযোগ উঠেছে-বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. আব্দুল হাকিম সরকারের স্ত্রী চাকুরি বাণিজ্যের ডেক্স খুলে বসেছেন। শিক্ষক ও কর্মকর্তা নিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়ে অংখ্য প্রার্থীর কাছ থেকে তিনি মোটা অংকের ঘুষ নিয়েছেন। সম্প্রতি নিয়োগ কার্যক্রম স্থগিত হওয়া একটি বিভাগের প্রভাষক পদের এক প্রার্থী সাথে ভিসির স্ত্রীর ৬ লক্ষ টাকা প্রদানের চুক্তি হয়েছিলো বলে ওই প্রার্থী নিশ্চিত করেছেন।শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের প্রক্রিয়া থেকে বাণিজ্যের সুযোগ হাতছাড়া করেনি ছাত্রলীগ নেতারাও। প্রশাসনের সাথে দর কষাকষি করে প্রত্যেকটি বিভাগে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে দুই জন করে প্রার্থী দিয়েছে ছাত্রলীগ। বিনিময়ে আহবায়ক কমিটির সদস্যরা প্রত্যেক প্রার্থীর কাছ থেকে নিয়েছেন ৫ থেকে ১৫ লক্ষ টাকা। কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের আহবায়ক কমিটি অর্ধ কোটি টাকার বাণিজ্য করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।এ বিষয়ে শিক্ষক সমিতির সভাপতি প্রফেসর ড. নজিবুল হক ও সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর ড. ইকবাল হোছাইন বলেন-‘যে কয়েকটি বিভাগে নতুন শিক্ষক নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে তার সবগুলো অবৈধ। প্লানিং কমিটির সুপারিশ ছাড়াই নতুন শিক্ষক নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। আমরা ভিসিকে বার বার বলেছি নিয়মের মধ্যে থেকে অস্থায়ীদেরকে স্থায়ী করতে। কিন্তু প্রত্যেকটি নিয়োগে অবৈধ লেনদেনের কারনে প্রশাসন নতুন নিয়োগ দিয়েছে। প্লানিং ছাড়া কোন নিয়োগের সুপারিশ সিন্ডিকেটে না নেওয়ার জন্য ভিসিকে আমরা বলেছি। এর পরেও নিয়োগ হলে শিক্ষক সমিতি সরাসরি ভিসি পতনের আন্দোলনে যাবে।’ভিসি প্রফেসর ড. আব্দুল হাকিম সরকার অবৈধ লেনদেনের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন-‘শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্যতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। অস্থায়ীদের স্থায়ী করার বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নতুন নিয়োগ দেওয়ার সংস্কৃতি এ বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে।’

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন