রবিবার, আগস্ট ১৭, ২০১৪

১৪ কোটি টাকার গড়াই নদীর পার সংরক্ষণ ডাইক ধ্বসে যাওয়ায় আতঙ্কিত এলাকাবাসী


স্টাফ রিপোর্টার : লবণাক্ততার আগ্রাসনে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পরিবেশ বিপর্যয় রোধ করে জীববৈচিত্র, গ্রেট ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন, কৃষি ও মৎস সম্পদ রক্ষা এবং নৌ-পথের নাব্যতা উদ্ধারে সরকার অগ্রাধিকার বিবেচনায় কুষ্টিয়ার পদ্মা নদীর প্রধান শাখা গড়াই নদী পূনরুদ্ধার প্রকল্প বাস্তবায়নে বিপুল অর্থ ব্যয়ে নদী খননের মত বিশাল কর্মযজ্ঞ গ্রহণ করলেও তা ভেস্তে যেতে বসেছে। এই প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দায়িত্বহীনতা ও যোগসাজসে প্রকল্পের বরাদ্দকৃত অর্থ লুটপাট হলেও কাজের কাজ কিছুই না হওয়ায় ধ্বসে গেছে পার সংরক্ষণ ডাইক, এতে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে এলাকাবাসী। সংবাদ পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করলেন জেলা প্রশাসক সৈয়দ বেলাল হোসেন।
গড়াই নদীর নাব্যতা উদ্ধারে ২য় ধাপে শুরু হওয়া খনন প্রকল্পের প্রারম্ভেই নদী তীরবর্তী জনগন ফুঁসে উঠে অপরিকল্পিত নদী খননের অভিযোগ তুলে। তারা বিষয়টি তুলে ধরে অসংখ্যবার জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ বরাবর লিখিত অভিযোগ দেয়াসহ তাদের দাবি আদায়ে কুষ্টিয়ার পানি উন্নয়ন বোর্ড, জেলা প্রশাসন, ড্রেজিং প্রকল্প এলাকা ঘেরাওসহ মানব বন্ধন ও সাংবাদিক সম্মেলন করেছে সংশ্লিষ্ট মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে। কিন্তু কোন কিছুতেই সাড়া মেলেনি সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে। এভাবেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন সদর উপজেলার হাটশ হরিপুর ইউনিয়ন পরিষদ’র চেয়ারম্যান ও নদী ভাঙ্গন প্রতিরোধ সংগ্রাম কমিটি’র আহ্বায়ক এম মুশতাক হোসেন মাসুদ।
এলাকাবাসীর অভিযোগ প্রতি বছর নদীর তলদেশ ড্রেজিং করে খননকৃত বালি অরক্ষিত অবস্থায় নদীর তীরেই রাখার ফলে বন্যার সময় ঐ বালি পূনরায় নদীতে চলে যায় এবং নদী ভরাট হয়ে যায়। একদিকে উজান থেকে নতুন করে ভেসে আসা বালি সেই সাথে খননকৃত বালি একসাথে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে জনবসতি ও কৃষিজমি ভেঙ্গে নদীগর্ভে চলে যাচ্ছে, সেই সাথে নাব্যতা হারাচ্ছে। সেকারণে কোটি কোটি টাকা খরচ করে ফলাফল শুন্য
খনন কাজের বিরোধীতা করে আসছিল এলাকাবাসী।
চলতি বছরের শুষ্ক মৌসুমের জানুয়ারীতে ড্রেজিং শুরুর প্রাক্কালে এলাকাবাসীর আন্দোলনের মুখে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ খননকৃত বালি সংরক্ষনের অঙ্গীকার করেন এবং সেই অনুযায়ী নতুন করে ড্রয়িং ডিজাইন করে প্রাথমিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এজন্য চারটি স্পট চিহ্নিত করে সেখানে সম্ভাব্যতা যাচায় শেষে ডাইক (সংরক্ষণ বাঁধ) নির্মাণের জন্য চারটি গুচ্ছ প্রকল্প’র অনুকুলে সাড়ে ১২ কোটি টাকা বরাদ্দ ধার্য করে টেন্ডারের মাধ্যমে ঠিকাদারদের কার্যাদেশ প্রদান করেন। উল্লেখ্য কার্যাদেশ প্রাপ্ত ঠিকাদারগণ নির্ধারিত বরাদ্দ ছাড়াও ১০% উদ্ধৃত্ত ব্যয় ধরিয়ে কার্যাদেশ গ্রহণ করেন। এবছরের ৪ এপ্রিল-এ কার্যাদেশ প্রদান করে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
গুচ্ছ প্রকল্প গুলি যথাক্রমে- (খড়ঃ ঘড়: এজজচ-২/উণক/২০১৩-১৪/খড়ঃ-০১) বরাদ্দকৃত টাকা- =৩৭৯১৩৬১২/=(তিন কোটি উনআশি লক্ষ তের হাজার ছয়শত বার টাকা)সহ ১০% উদ্ধৃত্ত সংযুক্তি, সর্বমোট ৪ কোটি ১৮লক্ষ টাকা।
(খড়ঃ ঘড়: এজজচ-২/উণক/২০১৩-১৪/খড়ঃ-০২) বরাদ্দকৃত টাকা- =২৪৩১৬৮৬৩/=(দুই কোটি তেতাল্লিশ লক্ষ ষোল হাজার আটশত তেষট্টি টাকা)সহ ১০% উদ্ধৃত্ত সংযুক্তি, সর্বমোট ২ কোটি ৬৮লক্ষ টাকা।(খড়ঃ ঘড়: এজজচ-২/উণক/২০১৩-১৪/খড়ঃ-০৩) বরাদ্দকৃত টাকা- =৩০৬৯৭৫৮০/=(তিন কোটি ছয় লক্ষ সাতানব্বই হাজার পাঁচশত আট টাকা)সহ ১০% উদ্ধৃত্ত সংযুক্তি, সর্বমোট ৩ কোটি ৩০লক্ষ টাকা প্রায়। (খড়ঃ ঘড়: এজজচ-২/উণক/২০১৩-১৪/খড়ঃ-০৪) বরাদ্দকৃত টাকা- =৩০৩৭২৯০২/=(তিন কোটি তিন লক্ষ বাহাত্তর হাজার নয়শত দুই টাকা)সহ ১০% উদ্ধৃত্ত সংযুক্তি, সর্বমোট ৩ কোটি ৩০লক্ষ টাকা প্রায়। প্রকল্পগুলির মোট ব্যয় ধরা হয় প্রায় সাড়ে তেরো কোটি টাকা।
খননকৃত বালি সংরক্ষণের জন্য গৃহীত উল্লেখিত ৪টি গুচ্ছ প্রকল্পের টেন্ডার প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে বাস্তবায়ন পর্যন্ত সকল ক্ষেত্রে চরমভাবে অসচ্ছতা বজায় রেখে চলেছে এই প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকল্প পরিচালক নাজির আহমেদ, নির্বাহী প্রকৌশলী নইমুল হক, উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম এবং এস ও মাহমুদ। এভাবেই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন হাটশ হরিপুর ইউপি সদস্য ও নদী ভাঙ্গন প্রতিরোধ সংগ্রাম কমিটির সদস্য বজলুর রহমান।
ইউপি সদস্য মনিরুল ইসলাম বলেন, প্রায় সাড়ে তের কোটি টাকা ব্যয়ে নদীর পাড় সংরক্ষণের জন্য বরাদ্দ দেয়া হলেও কার্যাদেশে উল্লেখিত সঠিক পরিমাপ মত উপাদান ব্যবহার করে ড্রয়িং ডিজাইনমত কাজ কোথাও চোখে পড়ার মত দেখা যাচ্ছে না। অথচ নির্বাহী প্রকৌশলী নইমুল হক’র দৃষ্টি আকর্ষণ করেও তাতে কোন লাভ হয়নি। এতে প্রমাণ হয় যে, এখানে যা কিছু অনিয়ম দূর্ণীতি হচ্ছে তাতে তিনি নিজেও জড়িত। বিষয়টি সরকারের উচ্চ মহল থেকে তদন্ত হওয়া দাবি করছি।
ইউপি সদস্য সেলিম উদ্দিন বলেন, গড়াই অপটেক সংরক্ষণে বরাদ্দকৃত প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে যে কাজ শেষ হয়েছে তার কোন চিহ্নই এখন আর দেখা যাচ্ছে না। এবিষয়ে আমরা নির্বাহী প্রকৌশলী নইমুল হক’কে জানিয়েছি।
ইউপি সদস্য শরিফুল ইসলাম জানান, “পানি উন্নয়ন বোর্ডের দূর্ণীতিবাজ কর্মকর্তাদের কারণে ডাইক প্রটেকশন কাজ সিডিউল অনুযায়ী না করায় যেভাবে প্রকল্পের টাকা পুকুর চুরির মত লুটপাট হয়েছে তাতে পূর্বেই আমরা ধারণা করেছিলাম যে, এই সংরক্ষণ ডাইক টেকসই হবে না; অতি জরুরী সরকারের উচ্চপদস্থ কর্তৃপক্ষের কাছে আমি এর সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করছি”।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উচ্চ পদস্থ একটি বিশ্বস্ত সূত্রে (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, রেকর্ড আছে) জানা যায়, গড়াই নদী পুনরুদ্ধার প্রকল্পে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হলেও এর কোন টেকসই সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। এই অবস্থা চলতে থাকলে সরকারের কোন উদ্যেগই বাস্তবায়ন হবে না। দীর্ঘদিন ধরে খনন প্রকল্প চলমান থাকলেও তা পরিকল্পিত ভাবে সংরক্ষন না হওয়ায় সুফল পাওয়া যাচ্ছিল না; সেকারণে এবছরই প্রথমবারের মত সংরক্ষণের জন্য প্রকল্প হাতে নেয়া হলেও অনিয়ম, দূর্ণীতি, সঠিক ড্রয়িং ডিজাইনসহ পরিমাপ না মানা এবং নি¤œমানের উপকরণ ব্যবহার করায় এখাতে বরাদ্দকৃত পুরো টাকা গচ্ছা হয়েছে। সঠিক কাজ না করার ফলেই এভাবে ভেঙ্গে যাচ্ছে।
এবিষয়ে প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কার্যাদেশ প্রাপ্ত একজন ঠিকাদার জানান, দেখুন সংশ্লিষ্ট দপ্তরের নির্দেশনা বা প্রচ্ছন্ন ঈশারা ছাড়া কোন ঠিকাদারের ক্ষমতা নাই যে, কাজে অনিয়ম বা কাজ না করে সরকারী টাকা লুটপাট করতে পারে।
এসও মাহমুদের সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, “এবিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না, কোন কিছু জানার থাকলে এক্সেনের সাথে কথা বলেন”।
এবিষয়ে উপবিভাগীয় প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামের সাথে কথা বলতে চাইলে তিনি বলেন, “আমার কাছে প্রকল্পের কোন ডকুমেন্ট নেই। সকল ফাইলপত্র এক্সেন সাহেবের কাছে, উনার সাথে কথা বলেন”।
কুষ্টিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নইমুল হক’কে অসংখ্যবার মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি ফোন ধরেননি।
গড়াই নদী পুনরুদ্ধার প্রকল্প ২য় ধাপ’র দায়িত্ব পালনকারী প্রকল্প পরিচালক নাজির আহমেদ’র সাথে প্রতিবেদক আলাপকালে তিনি জানান, “কুষ্টিয়াতে স্থানীয় ভাবে ঐ প্রকল্পের দায়িত্বে আছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নইমুল হক। তিনি ভালো বলতে পারবেন প্রকল্পের সর্বশেষ রিপোর্ট। উনার সাথে কথা বলেন। কোন অনিয়ম হয়ে থাকলে সেটা উনিই ভালো জানেন”। সেখানে কোন অনিয়ম হলে তদন্ত করে দেখা হবে।
ঘটনাস্থল পরিদর্শনকালে কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক সৈয়দ বেলাল হোসেন বলেন, গড়াই খননের কাজ দেখভাল করার দায়িত্ব পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের। প্রতি বারই খনন হচ্ছে, পার প্রটেকশন হচ্ছে কিন্তু প্রতিবারই ভেঙ্গে যাচেছ এবং নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এবিষয়টি আসলে একটি বিশেষজ্ঞ টিম করে তদন্ত হওয়া দরকার যে, কেন এমনটা হচ্ছে। স্থানীয়দের দেয়া অনিয়মের অভিযোগ খতিয়ে দেখা হবে। কোন অনিয়ম হয়ে থাকলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন