বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ১৭, ২০১৪

আজ ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

আক্তারুজ্জামান, মেহেরপুর : আজ ১৭ এপ্রিল। ঐতিহসিক মুজিবনগর দিবস। আজ থেকে ৪৩ বছর আগে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল শনিবার বেলা ১১ টার দিকে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে এক অনাড়ম্বর পরিবেশে অনুষ্টিত হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকারের শপথ গ্রহন। শপথ অনুষ্ঠানে পাঠ করা হয় স্বাধীনতার ঘোষনা পত্র। স্বাধীনতার মহামন্ত্রে উদ্বীপ্ত বাঙালী ও ১২৭ জন দেশী বিদেশী সাংবাদিকের উপস্থিতিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন মন্ত্রী সভার সদস্যদের পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। পরিচয় অনুষ্টানের সাত দিন আগে ১০ এপ্রিল ”৭১ এ গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠনের ঘোষনা প্রদান করা হয়। যার নামকরন হবে বিপ্লবী সরকার। বৈদ্যনাথতলা ছিল এক অপরিচিত গ্রাম। ১৭ এপ্রিল ”৭১ এ বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের শপথ গ্রহন অনুষ্টানে মেহেরপুরের এই গ্রামটির নামকরন করা হয় মুজিবনগর। শপথ অনুষ্টানে প্রধানমন্ত্রী তাজউর্দ্দীন আহমেদ ঘোষনা করেন,আজ থেকে(১৭ এপ্রিল) বৈদ্যনাথ তলার নাম হবে মুজিবনগর।
১৬ এপ্রিল রাতের মধ্যেই তৎকালীন সময়ের জাতীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ উপস্থিত হতে থাকে সীমান্ত জেলা মেহেরপুরে। জেলার স্বাধীনতাকামী মানুষের মাঝে বিরাজ করে এক পুলকিত অনুভব। উদ্বেগ আর উত্তেজনার প্রহর কাঁটে। আকাশে কালো মেঘ জমে। রাতের নিস্তদ্ধতা বেয়ে বৃষ্টি নামে মহাকুমার সমগ্র এলাকা জুড়ে। এ যেন নিদ্রাহীন অপেক্ষমান বাঙালি জাতীর জন্য প্রকৃতির এক নিরব আর্শিবাদ। অপেক্ষার পালা শেষ। এক সময় রাএী পোহায়। মেহেরপুরের নীল আকাশে উদিত হয় নতুন প্রত্যয়দীপ্ত সূর্য। আসে সেই স্বর্ণাক্ষরে লেখা তারিখ ১৭ এপ্রিল। বাঙালী জাতির কাংক্ষিত স্বাধীন রাষ্ট্রের সরকার প্রতিষ্ঠার সেই স্মরনীয় দিন। বৈদ্যনাথতলার আম্রকুঞ্জের ছায়ায় নিরাভারন,অনাড়ম্বর কিন্তু গভীর আন্তরিকতা দিয়ে আয়োজিত অনুষ্টান স্থলে পাশ্ববর্তী এলাকা থেকে সংগৃহিত হয়েছিল চেয়ার বেঞ্চ। সংগৃহিত এসব চেয়ার বেঞ্চের বেশির ভাগই ছিল পুরানো। কোনটির হাতল ভাঙ্গা, ছিল পায়াভাঙ্গা,ছিলনা চাকচিক্যতা। আর এসব আসনে বসে ছিলেন,সেদিন বাঙালী জাতীর স্বাধীনতার অগ্রদূতরা,স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারের মন্ত্রীবর্গ। পূর্বের রাতের(১৬ এপ্রিল) বৃষ্টি ভেঁজা আম্রকুঞ্জের ভারি বাতাসকে ফাঁকি দিয়ে ওঠা সূর্যের পরিচ্ছন্ন আলোয় বৈদ্যনাথতলা যখন আলোয় উদ্ভাসিত, তখন সকাল গড়িয়ে দুপুর। সোনালী রোদে জড়ো হওয়া হাজার হাজার স্বাধীনতাকামী মানুষ অগ্রগামী সঙ্গীতের প্রত্যাশায় উন্মুখ। অপেক্ষার পালা শেষ করে এলো সেই মহেন্দ্রক্ষন। শুরু হলো মূল অনুষ্টান। পৃথিবীর মানচিত্রে আনুষ্ঠানিকভাবে অভ্যূদয় হলো একটি নতুন দেশের। সমগ্র বিশ্ববাসী জানলো মুজিবনগর স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী। আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের ঘোষনাপত্র পাঠ এবং নব-গঠিত মন্ত্রীসভার শপথ গ্রহন অনুষ্ঠিত হলো। এ সময় উপস্থিত হাজার
হাজার মুক্তিপাগল বাঙালী,শত শত মুক্তিযোদ্ধা আনন্দে উল্লাসে “জয় বাংলা” শ্লোগানে আম্রকুঞ্জের বাতাস প্রকম্পিত করে তুললেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে রইলো এই দিনটি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্দ্ধু শেখ মুজিবর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষনার পর পাকিস্থানী হানাদার বাহিনী বাঙালী হত্যাযঞ্জে ঝাঁপিয়ে পড়লে বাংলার আপামর জনতা পাকস্থানী নরপশু সৈন্যবাহিনীর মোকাবেলায় মরনপণ যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে বাংলার স্বাধীনতার রক্তিম লাল সূর্য “মীরজাফর”,“উমিচাঁদের” বিশ্বাসঘাতকতায় অস্তিমিত হয়,২১৪ বছর পর আবারো ’৭১ সালের ১৭ এপ্রিল সেই পলাশীর অনতিদূরে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আর এক আম্রকাননে নতুন সূর্যে স্বাধীন পতাকা,শপথ নিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার। আনুষ্ঠানিকভাবে বাঙালী জাতী সারা বিশ্বকে জানিয়ে দিল আতœ প্রতিষ্ঠার কথা। স্বাধীন জাতী,স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে এগিয়ে যাবার কথা। বস্তুতঃ এই দিনটি আমাদের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত এক পরম গৌরবোজ্জল দিন। ১৭ এপ্রিল আমাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে অত্যন্ত গুরুত্ববহ। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরের অস্থায়ী সরকার বঙ্গবন্দ্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে রাষ্ট্রপতি ঘোষনা করে। ’৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষনার পর পাকি¯থানী হানাদার বাহিনী তাকে গ্রেফতার করে। তিনি পাকি¯থানের কারাগারে বন্দী থাকায় তাঁর অনুপস্থিতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি,তাজউর্দ্দীন আহমেদ প্রধানমন্ত্রী,খোন্দকার মুশতাক আইন ও পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। অনুষ্ঠানে কর্নেল আতাউল গণি ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি ঘোষনা করা হয়। শপথ অনুষ্ঠানে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশ সরকারের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। আর হৃদয় নিংড়িয়ে ছলছল চোখে মা হারা বাবা হারা সন্তানেরা ধর্ষীতা মা আর বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে পাওয়া একটি সার্বভৌতের উপর পা রেখে গেয়ে ওঠে আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালো বাসি। চিরদিন তোমার আকাশ তোমার বাতাস আমার প্রানে ও মা আমার প্রানে বাজায় বাশি, সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালো বাসি।   “১৭ এপ্রিল ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস” বিশ্বের ইতিহাসে এক অবিস্মরনীয় নাম। স্বভাবত দেশী-বিদেশী পর্যটকরা প্রতি বছর ছুটে আসেন ঐতিহাসিক স্থানটিকে একঝলক দেখার জন্য। কিন্তু এসেই তারা অনেকটা হতবাক হয়ে যায়। কারন মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ,কমপ্লেক্্র,রেষ্টহাউজ, হেলিপ্যাড, দেখার সাথে সাথে পর্যটকরা স্বল্প সময়ের মধ্য জানতে চায় মুজিবনগরের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। দুঃখজনক হলেও সত্য সরকারিভাবে কোন গাইডের ব্যবস্থা নেই। যাদের সাহায্য নেবে পর্যটকরা। ইতিহাসের পাতা থেকে জানা যায়,মিশরের পিরামিডও ঐতিহাসিক স্থান। দর্শনীয় স্থানটিকে দেখতে সারা বিশ্ব থেকে প্রতিদিন জড়ো হয় হাজার হাজার পর্যটক। তবে পর্যটকদের বিন্দু মাত্র সমস্যায় পড়তে হয়না এর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস জানতে। কারন পিরামিডের সম্মুখ ভাগেই মার্বেল পাথরে খোদায় করে লেখা রয়েছে এক নজরে পিরামিডের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। অথচ মুজিবনগরের ইতিহাসে ৪৩ বছর পার হলেও“এক নজরে” মুজিবনগর এ ধরনের স্মৃতিফলক অদ্যাবধি চোখে পড়েনি। মুজিবনগর দিবস কারো ব্যক্তিগত দিবস নয়। এই দিবস সমগ্র বাঙালী জাতির। স্বাধীনতাকামী মুক্তিপাগল বাঙালীর। ১৯৭২-২০০৬ সাল পর্যন্ত মুজিবনগর দিবস পালনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়,বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ এবং এরশাদের জাতীয় পার্টি(১৯৮৬-৮৭ সালে দু’বার) ছাড়া বাংলাদেশের কোন রাজনৈতিক দলই দলীয় বা সরকারি ভাবে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবস পালন করেনি বা করেনা। এ সময় পত্রিকাগুলোতে বের হয়েছে বিশেষ ক্রোড়পত্র। স্বাধীনতার ৪৩ বছরে মুজিবনগরের উন্নয়নে তৎকালীন জাতীয পার্টি সরকার ও বিগত আওয়ামীলীগ সরকারের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। এরশাদ সরকার প্রথম শুরু করেন মুজিবনগরের উন্নয়ন। গড়ে তোলেন মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ,রেষ্টহাউজ,স্বাধীনতা ক্লাব,পাঠাগার এবং গেইট। কিন্তু এরশাদ সরকারের পতনের পর দীর্ঘদিন স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিল মুজিবনগরের উন্নয়ন। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসার পর শুর“ করেন “মুজিবনগর কমপ্লেক্্র” গড়ে তোলার কাজ। মেহেরপুরের আপামর জনতার দাবি শপথ অনুষ্টানে অংশ নেওয়া মুক্তিযোদ্ধা,সুশীল সমাজের প্রতিনিধি এবং গার্ড অব অনার প্রদানে অংশ নেওয়া আনসার সদস্যদের দাবী-যদি আমরা ইতিহাসকে মানি,মুজিবনগরকে যদি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম রাজধানী মানি,তাহলে কেন“১৭এপ্রিল”কে জাতীয় শপথ দিবস ঘোষনা করা হবেনা। যত তাড়াতাড়ি বর্তমান সরকার“১৭ এপ্রিল” দিনটিকে ‘জাতীয় শপথ দিবস’ হিসেবে ঘোষনা দিয়ে মূল্যায়ন করা এবং জেলাবাসীর দাবী মেটানো সম্ভব হবে সমগ্র দেশ-বিদেশে বর্তমান সরকারের ভাবমূর্তি তত বৃদ্ধি পাবে এতে কোন সন্দেহ নেই।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের ঠিকনা,মুক্তিকামী স্বাধীনতাপ্রিয় বাঙালী জাতির একমাএ ঠিকানা“মুজিবনগর” এর উন্নয়নের অগ্রযাএার রথকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবার কার্যক্রমে দেশ,জাতি এবং সরকারের সাথে মেহেরপুর জেলাবাসীও অগ্রনী ভূমিকা পালন করে আসছে এবং আগামী দিনগুলোতেও পালন করে যাবে এ প্রত্যয় ব্যক্ত করেন জেলার সর্বস্তরের মানুষ। বর্তমান সরকারের সুদৃষ্টি ও সহযোগীতায় মুজিবনগর তার গৌরবজ্জল ভূমিকার স্বার্থকতা পাবে এ প্রত্যাশা মুজিবনগরের মানুষের।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন