বুধবার, ডিসেম্বর ২৪, ২০১৪

কুষ্টিয়া সরকারী কলেজ দুর্নীতির আখড়া

নিষ্পতি হয়নি কোটি টাকার অডিট আপত্তি

অধ্যক্ষের ইচ্ছায় লোপাট হচ্ছে বিভিন্ন খাতের টাকা


স্টাফ রিপোর্টার : কুষ্টিয়া সরকারী কলেজে ভর্তি আর ফরম পুরনের সময় কলেজর উন্নয়নে বিভিন্ন খাতে অর্থ আদায় করা হলেও তা দিয়ে কোন উন্নয়ন হয় না এমন অভিযোগ শিক্ষার্থীদের। সেই অর্থ কিভাবে ব্যয় হয় তা নিয়ে রয়েছে ধোয়াশা। আত্মসাৎ’র অভিযোগও তুলছেন অনেকেই। এরপর অনুসন্ধানে নামে দৈনিক হাওয়া। অনুসন্ধানে বের হয়েছে নানা তথ্য। অডিটেও অনিয়ম পাওয়া গেছে। অডিট আপত্তিতে এক বছর ঝুলে আছে অডিট নিষ্পত্তি।
কম্পিউটার ল্যাব
কুষ্টিয়া সরকারী কলেজে কম্পিউটার ল্যাবে কম্পিউটার রয়েছে মাত্র ১৬টি। এরমধ্যে ১০টি কম্পিউটার অকেজো। সচল ৬টি। এই ৬টি কম্পিউটারে শিক্ষার্থী ছাড়াও শিক্ষকদের প্রশিক্ষন দেয়া হয়। ফলে
২৪ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে হাতে গোনা কয়েকজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থী ছাড়া বাকিদের সুযোগ হয় না কম্পিউটার ব্যবহারে। সরকারী কলেজের ল্যাবে যে কম্পিউটার আছে তা একটি প্রকল্প থেকে প্ওায়া। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ায় তা এখন কলেজের সম্পত্তিতে পরিনত হয়েছে। অথচ এই খাতে ভর্তি আর ফরম পুরনের সময় প্রতি শিক্ষার্থীর কাছ থেকে নেয়্ াহয় ৩০ টাকা করে। কলেজের হিসেবে এই খাতে ৮০ লাখ টাকার ফান্ড থাকার কথা। কিন্তু সেই ফান্ডের টাকায় কম্পিউটার ল্যাবের উন্নয়নে এক টাকাও ব্যায় হয়নি। এদিকে সম্প্রতি শিক্ষার্থীদের নিকট থেকে জনপ্রতি নগদে ৪০ টাকা করে আদায় করা হয়েছে কম্পিউটার বিভাগের ব্যবহারিক পরীক্ষার নামে। সেসময় অন্তত দেড় হাজার শিক্ষার্থীর নিকট থেকে আদায় করা হয় প্রায় ৫০ হাজার টাকা। সে অর্থেরও একটি টাকা কম্পিউটার খাতে ব্যায় হয়নি। শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন, তাদের কাছ থেকে নেয়্ াএই টাকা ব্যয় হয় কোন খাতে ? এ প্রশ্নের সদুত্তর নেই কর্তৃপক্ষের।
ছাত্রসংসদ
কলেজে ভর্তির সময় ছাত্র সংসদের নামে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেয়া হয় ৩’শত টাকা করে। একাধিক শিক্ষকের দাবী, কলেজ ছাত্রসংসদে প্রায় দুই কোটি টাকা জমা থাকার কথা। দীর্ঘদিন ধরে ছাত্র সংসদ অকার্যকর হওয়ায় খরচের প্রশ্নই আসে না। তাহলে সেই টাকার কি অবস্থা এমন প্রশ্ন শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সুধীমহলের। সরেজমিন এই টাকার ফান্ডের খোঁজ খবর নিতে গেলে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ শুরু করেন তালবাহানা। কলেজের প্রধান হিসাব রক্ষক বললেন, টাকার ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না। তিনি কুষ্টিয়া সরকারী কলেজের প্রধান সহকারী আসকর আলীর সাথে যোগাযোগ করতে বলেন। আর প্রধান সহকারী বললেন, এই ফাইল আছে হিসাব রক্ষকের কাছে। প্রধান কর্তা ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন তিনি। এব্যাপারে ইসলাম শিক্ষা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক প্রফেসর মোহাম্মদ আলী ইছা জানান, ছাত্র সংসদের মোটা অংকের টাকা জমা আছে। এর দেখভাল করেন অধ্যক্ষ। তিনিই বলতে পারেন ফান্ডের কি অবস্থা।
কলেজের উন্নয়ন ফি
কলেজে ভর্তির সময় ও ফরম পুরনের সময় কলেজের উন্নয়ন ফি বাবদ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে জনপ্রতি নেয়া হয় ২’শত টাকা করে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শিক্ষক জানান, প্রায় ৮৭ লাখ টাকা জমা আছে কলেজের উন্নয়ন ফান্ডে। শিক্ষকদের এমন দাবী শুনে মনে হতেই পারে তাহলে তো কলেজের উন্নয়নে মহাযজ্ঞ চলছে। কিন্তু বাস্তবে তা নেই। সরেজমিন কলেজ ঘুরে দেখা যায়, কলেজের ৩০০৭, ৩০০৮, ৩০০৯ রুমে বেঞ্চ স্বল্পতা। শিক্ষার্থীদের পাঠদান করার সময় অনেককেই দেখা গেল দাঁড়িয়ে থাকতে। শিক্ষকরা জানান, এ নিয়ে অধক্ষ্যকে একাধিকবার বলার পরও কর্ণপাত করেননি তিনি। গত তিন বছরে শতাধিক বেঞ্চ নষ্ট হলেও তৈরি করা হয়নি একটি বেঞ্চও। কলেজের বাথরুমগুলোর বেহাল অবস্থা। শিক্ষার্থীরা এনিয়ে একাধিকবার অভিযোগ করলেও বাথরুমগুলোর অবস্থার উন্নয়ন হয়নি। এই যখন কলেজের অবস্থা তাহলে কলেজের উন্নয়ন তহবিল কিভাবে বায় হচ্ছে সে প্রশ্ন সবার। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ৩ বছরে কলেজে উন্নয়ন বলতে মাত্র ২০টি ফ্যান লাগানো হয়েছে। এই তহবিলের অর্থ তছরুপের অভিযোগ উঠেছে।
পরিবহন
কুষ্টিয়া সরকারী কলেজে নেই পরিবহন। তারপরও শিক্ষার্থীদের ৫০ টাকা করে পরিবহন ফি দিতে হয় ভর্তি ও ফরম পুরনের সময়। এব্যাপারে কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, বোর্ডে যাওয়া আসার জন্য কর্মচারীদের গাড়ি ভাড়া দিতে হয়। সেকারনেই পরিবহন ফি নেয়া। একাধিক সুত্র দাবী করেছে, পরিবহন ফি বাবদ ফান্ডে টাকা থাকার কথা সাড়ে বারো লাখ। বছরে প্রতিদিন যদি একজন কর্মচারী বোর্ডে যাওয়া আসে করে তাহলে সব্বোর্চ খরচ হওয়ার কথা দেড় লাখ টাকা। সেক্ষেত্রে ফান্ডের বাকী এগার লাখ কিভাবে ব্যায় হচ্ছে এ প্রশ্ন শিক্ষার্থীদের। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শিক্ষক জানান, পরিবহন খাতের টাকার অধিকাংশ নয় ছয় করা হয়। কলেজের কর্তাব্যক্তিরা বিভিন্ন স্থানে যাওয়ার নামে এই টাকা ব্যয় করেন।
চিকিৎসা
কুষ্টিয়া সরকারী কলেজের কোন শিক্ষার্থী অসুস্থ্য হলে নিয়ে যাওয়া হয় কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে। কলেজে কোন আবাসিক চিকিৎসক নেই বলে জানিয়েছে শিক্ষার্থীরা। তাহলে প্রতি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেয়া ৫০ টাকা কিভাবে ব্যায় হয় জানা নেই শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের। একাধিক সুত্র দাবী করেছে, এই খাতে জমা রয়েছে প্রায় বিশ লাখ টাকা।
রোভার
বিজয় দিবসে এবার রোভারের জন্য বরাদ্দ ছিল প্রায় সাড়ে ষোল হাজার টাকা। রোভাররা জানিয়েছেন, বছরে তাদের জন্য সর্ব্বোচ্চ ব্যায় হয় পঞ্চাশ হাজার টাকা। অথচ ভর্তি ও ফরম পুরনের সময় এই খাতে বছরে লক্ষাধিক টাকা আদায় হয় শিক্ষার্থীদের নিকট থেকে। সবার প্রশ্ন এই টাকার উদ্ধত্ত টাকা ব্যয় হয় কিভাবে।
বিবিধ
বিবিধ খাতের টাকা ব্যয় করা হয় বিভিন্ন উপায়ে। শিক্ষকরা বলছেন, কলেজের এক কর্তা ব্যক্তির ইচ্ছার উপর নির্ধারিত হয় এই খাতের টাকা কিভাবে ব্যয় হবে। এক কর্তার ব্যক্তির ইচ্ছা মাফিক ব্যয় হওয়ার কারনে এই অর্থ লুটপাটের সুযোগ বেশি। কলেজের ভর্তি ও ফরম পুরনের সময় এই খাতে টাকা নেয়া হয় ১’শ টাকা করে।
বার্ষিক অডিট
কলেজের হিসাব নিকাশ নিয়ে প্রতিবছরই অডিট হয়। কুষ্টিয়া সরকারী কলেজের ২০১৩ সালের জুন মাস পর্যন্ত দুই বছরের অডিট হয়েছে গত বছর। এ অডিট শেষে স্থানীয় অডিট উপশাখা থেকে কুষ্টিয়া সরকারী কলেজে একটি পত্র প্রেরন করা হয়েছিল, যাতে লেখা হয়েছিল চরম আর্থিক অনিয়ম পরিলক্ষিত হয়েছে। সেসময় ওই পত্রে ৭ দিনের মধ্যে অডিট নিষ্পত্তির সময়সীমা বেধে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু আজ পর্যন্ত অডিট নিষ্পত্তি হয়নি। একটি সুত্র জানায়, তৎকালীন স্থানীয় অডিট উপ শাখার যুগ্ম-সচিব আহসানুল জব্বার কুষ্টিয়া সরকারী কলেজে আসেন অডিট নিষ্পত্তিতে। কিন্তু কোটি টাকার উপরে হিসাব গোজামিল থাকায় তিনি অডিট নিষ্পত্তি না করে ফিরে যান। পরে অধ্যক্ষ রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ করলে বিষয়টি স্থগিত হয়। সুত্রের দাবী, ওই অডিটে প্রায় ২০টি খাতের অনিয়ম ধরা পড়ে। বের হয়ে আসে কলেজ অধ্যক্ষের অনেক দুর্নীতি। একটি সুত্র জানান, পরিপত্র অনুযায়ী কলেজের অধ্যক্ষ ভর্তি ও ফরম পুরনের বিভিন্ন কমিটির নিকট থেকে সব্বোর্চ ১০ হাজার টাকা গ্রহন করতে পারবেন। কিন্তু অধ্যক্ষ প্রতি কমিটির নিকট থেকে ১০ হাজারেরও বেশী টাকা নিয়েছেন। বার্ষিক অডিটে আপত্তির ব্যাপারে কলেজ কর্র্তৃপক্ষের সাথে আলাপ করলেও তারা কোন সদুত্তর দিতে পারেনি।
এব্যাপারে কুষ্টিয়া সরকারী কলেজের উপাধ্যক্ষ প্রফেসর মিজানুর রহমান বলেন, এসব ব্যাপারে কথা বলবেন কলেজের অধ্যক্ষ মহোদয়। তার সাথে যোগাযোগ করবেন।
কুষ্টিয়া সরকারী কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর বদরুদ্দোজা বলেন, আমি একটি সভায় আছি পরে কথা বলবো। এর আগে অধ্যক্ষের সাথে কথা বলতে কলেজে গেলেও তাকে পাওয়া যায়নি।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন