মঙ্গলবার, ফেব্রুয়ারী ১৯, ২০১৩

কুষ্টিয়ায় নীতিমালা ছাড়াই চলছে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র

কুদরতে খোদা সবুজ : মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের নামে কুষ্টিয়ায় ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে চিকিৎসালয়। অনুসন্ধানে দেখা যায়, এর সংখ্যা এখন বেশ চোখে পড়ার মত। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের কাছে এর কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। অনুমোদনহীনভাবে চলছে এগুলো। অনেক ক্ষেত্রে টাকা দিয়ে প্রশাসনকে ম্যানেজ করে চলছে এর কার্যক্রম। এসব জায়গা থেকে চিকিৎসাসেবা নিয়ে সুস্থ জীবনে ফিরে এসেছে এমন নজির কম। কেউ কেউ চিকিৎসা নিয়ে কিছুদিন ভালো থাকলেও আবারো তাকে ফিরে আসতে হচ্ছে। এ সুযোগে অভিনব পদ্ধতিতে নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসার নামে একটি চক্র হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। অথচ ওইসব কেন্দ্রের অধিকাংশের নেই কোনো বৈধ অনুমোদন এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। জেলার বিভিন্ন এলাকায় ভাড়া বাসা নিয়ে ব্যাঙের ছাতার মতো দিন দিন গজে উঠছে নতুন নতুন মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র। দেখা যায়, বেশির ভাগ নিরাময় কেন্দ্রে তালা মেরে রাখা হয় মাদকাসক্তদের। ভয়ঙ্কর মাদকাসক্তে আক্রান্তদের সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনতে পরিবারের লোকেরা এসব চিকিৎসা কেন্দ্রে পাঠিয়ে নানা উৎকণ্ঠায় থাকেন। সূত্র জানায়, বেসরকারিভাবে মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্র করতে হলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অনুমোদন প্রয়োজন। কিন্তু মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অনুমোদন না নিয়ে প্রতিদিন গড়ে উঠছে একের পর এক মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র। নামে-বেনামে গড়ে উঠা এসব নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসার নামে মাদকাসক্তদের ওপর চলে অমানবিক নির্যাতন। জেলখানার মতো ছোট্ট একটি রুমে মাদকাসক্তদের রেখে চিকিৎসার ব্যয়ভার হিসেবে পরিবারের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া হয় হাজার হাজার টাকা। চিকিৎসক নেই, নেই চিকিৎসা সরঞ্জাম, রোগীরা ঘুমায় মেঝেতে। জেলার বিভিন্ন মাদক নিরাময় কেন্দ্রের একই চিত্র। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলায় মাদক নিরাময় কেন্দ্র গুলো অন্ধকার, স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশ, ছোট ছোট রুম নিয়ে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র চলছে। এগুলোকে সেবামূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখিয়ে কিছু অসাধু চক্র ব্যবসা কেন্দ্রে পরিণত করে পরিচালনা করছেন। এসব কেন্দ্রে চিকিৎসা সুবিধা বলতে কিছু নেই। নানা অভিযোগ আর চিকিৎসার নামে রোগীর ওপর শারীরিক নির্যাতন, মাদক থেকে মুক্ত করার পরিবর্তে চিকিৎসা কেন্দ্রের মধ্যে মাদক সেবন করানো, জেলখানার আসামিদের মতো বন্দি করে রেখে রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে ইচ্ছামতো অর্থ আদায় করে নেয়া হয়। চার মাস থেকে শুরু করে কোনো কোনো কেন্দ্রে ছয় মাসে মাদকাসক্তদের সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনার চুক্তির নামে প্রতিমাসে ১০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে লক্ষাধিক টাকাও নেয়া হয়। কিন্তু চিকিৎসা কেন্দ্র থেকে বের হয়ে পরিবারের মাঝে ফিরে যাওয়ার পর আবার তারা পুরোনো জীবনে ফিরে যায়। ফলে সুস্থ না হওয়ায় পুনরায় তাদের ওইসব চিকিৎসা কেন্দ্রে ভর্তি করায় তাদের পরিবার। জেলার এক মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে কথা হয় মাদকাসক্ত যুবক রনির মা সেফালি বেগমের সঙ্গে। সেফালি বেগমের চার ছেলেমেয়ের মধ্যে রনি বড় ছেলে। জুতার দোকানে কাজ করতো রনি। বন্ধু বান্ধবের পাল্লায় পড়ে মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ে। প্রায় পাঁচ বছর ধরে মাদকে ভয়ঙ্করভাবে আসক্ত হয়ে পড়ার পর তাকে প্রথমে একটি বেসরকারি নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা করায়। সেখানে চিকিৎসায় কিছুটা ভালো হলেও পরে আবারো আসক্ত হয়ে পড়েন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সূত্র জানায়, ২০০৫ সালে প্রণীত হয় ‘মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র ও মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা বিধিমালা’. এ নীতিমালা অনুসারে কেন্দ্র পরিচালনার জন্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধন নেয়ার নিয়ম রয়েছে। বেসরকারি পর্যায়ে মাদকাসক্তি পরামর্শ কেন্দ্র, মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র ও মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা বা সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য ২০০৫ সালের জুনে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে একটি বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়। এই বিধিমালা অনুযায়ী প্রতিটি মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র সুরক্ষিত পাকা বাড়িসহ আবাসিক এলাকায় হতে হবে এবং এতে পর্যাপ্ত আলো বাতাসের সুবিধাসহ নিরিবিলি সুন্দর পরিবেশ থাকতে হবে। একই সঙ্গে থাকতে হবে পর্যাপ্ত প্রশস্ত জায়গা। সম্প্রতি নিরাময় কেন্দ্র থেকে বের হয়ে আসা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক যুবক অভিযোগ করেন, তারা যেখানে ছিলেন, সেখানে খাবারের মান খুবই নিম্নমানের। বিশেষজ্ঞ কোনো চিকিৎসক নেই। সারাদিন ছোট্ট একটি রুমে মাদকাসক্তদের একত্রে তালা মেরে রাখা হয়। বিভিন্ন সময়ে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়। এছাড়া মাদক থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য নিরাময় কেন্দ্রে এলেও এখানেই মাদকাসক্তদের মাদক সেবনের সুযোগ করে দেয়া হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, মাদকাসক্তদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি। অথচ মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্রে উপযুক্ত পরিবেশ নেই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন