বুধবার, সেপ্টেম্বর ১১, ২০১৩

এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম বস্ত্রকল কুষ্টিয়া মোহিনী মিল ফের বিক্রির ষড়যন্ত্র!

হাওয়া ডেস্ক : ক্ষমতার মসনদে বসে ক্ষমতাসীনরা এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম বস্ত্রকল কুষ্টিয়া মোহিনী মিল চালু করার আশ্বাস দিলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। বারংবার ক্ষমতার পালা বদল হলেও আলোর মুখ দেখেনি মিলটি। বরং মিলটি চালুর কথা বলে মিলটির যন্ত্রাংশ চুরি করে ধ্বংস করা হয়েছে এর মূল্যবান যন্ত্রাংশ। এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম বস্ত্রকল কুষ্টিয়া মোহিনী মিল ফের বিক্রির ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। কুষ্টিয়া অগ্রণী ব্যাংকের ৩ শত কোটি ১০ লাখ টাকা ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে মিলটি বিক্রির চক্রান্ত করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে ব্যাংকের কর্মকর্তা ও মিলের শ্রমিক কর্মচারীরা। ঢাকার মেসার্স এনারগোর্টিক লিমিটেড এর মালিক আরিফুর রহমান প্রায় ৪ শত কোটি টাকার মোহিনী মিলের সম্পত্তি মাত্র ৪৮ কোটি টাকায় কিনে নিয়েছেন বলে একটি বিশ্বস্তসুত্র জানিয়েছে। এ মিলটি বিক্রি হয়ে গেলে একদিকে এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম বস্ত্রকল কুষ্টিয়া মোহিনী মিল যেমন ধ্বংস হয়ে যাবে অপরদিকে কোটি কোটি টাকার সরকারের ক্ষতি হবে। তাই মিলটি রক্ষার জন্য দাবী জানিয়েছে কুষ্টিয়া মোহিনী মিলের শ্রমিক কর্মচারী ও এলাকাবাসী। এ নিয়ে তারা মানববন্ধন ও সমাবেশও করেছে।
তথ্যসুত্রে জানা যায়, বৃটিশ শাসনামলে অবিভক্ত বাংলায় দেশী কাপড়ের প্রতিশ্র“তি নিয়ে ১৯০৮ সালে গড়াই নদীর তীরবর্তী শহরের পূর্ব প্রান্তে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এশিয়া মহাদেশের সর্ব বৃহৎ বস্ত্রকল কুষ্টিয়া মোহিনী মিল। মোহিনী মোহন চক্রবর্তীর নামে এই শিল্প প্রতিষ্ঠানটির নাম রাখা হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ মিলের সমৃদ্ধ কাপড়ের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে দেশ বিদেশে। পরবর্তীতে এ মিলটি নিয়ে দেশীয়-বিদেশী ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত শুরু হয়। ১৯৬৫ সালে এই ঐতিহ্যবাহী মোহিনী মিলের উপর সর্বপ্রথম আঘাত আসে। তদানীন্তন রাজনৈতিক কারণে অর্থাৎ ভারত পাকিস্থান যুদ্ধের পর মিলটি “শক্রু সম্পত্তি” হিসাবে তালিকাভুক্ত করে। তৎকালীন সরকার ইপিআইডিসির কাছে মোহিনী মিল পরিচালনার ভার ন্যস্ত করে। ফলে মোহিনী মিল মালিকানা হারিয়ে বাধ্য দেশ ত্যাগ করে পশ্চিম বঙ্গে চলে যান। ১৯৭২ সালে স্বাধীনতার পর সরকার মোহিনী মিলকে জাতীয়করণ করে। স্বার্থান্বেষী মহল ও এক শ্রেনীর কর্মকর্তা কর্মচারীর আখের গোছানোর জন্য লোকসানের ফলে মিলটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিনত হয়। ১৯৭৭-৭৮ অর্থ বছরে ১৮ কোটি টাকা লোকসান দেয়। তদানীন্তন সরকার মিলটিকে লোকসানের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য যুক্তরাজ্য সরকারের মিলের একাংশে বি এম আর প্রকল্প স্থাপন করে। এই নতুন অংশে সর্বনিম্ন উৎপাদন হয় প্রতিদিন ১৫ বেল সুতা। এরপরও লোকসান দেখিয়ে ১৯৮২ সালের ৫ ফেব্র“য়ারী মিলটিকে লিকুইডেশন করা হয়। তখন শুরু হয় ব্যাপক শ্রমিক অসন্তোষ। মিলের ৩ হাজার শ্রমিক কর্মচারীর ভাগ্য অনিশ্চয়তার দিকে ধাবিত হয়। এসব শ্রমিক কর্মচারী পরিবারের ১০ হাজার মানুষ অর্ধাহারে অনাহারে অত্যান্ত মানবেতর অবস্থায় জীবন যাপন করে। অবশেষে ১৯৮৪ সালে এরশাদ এর শাসনামলে ৫০ কোটি টাকার মিল মাত্র ২৫ কোটি ২৬ লক্ষ টাকায় ব্যক্তি মালিকানায় বিক্রি হয়। এরপর কয়েকবার মিলটিকে চালু করার চেষ্টা করলেও সঠিকভাবে পরিচালনার অভাবে ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে ফের বন্ধ হয়ে যায়। এভাবেই বিভিন্ন সমস্যার কারণে অবিভক্ত বাংলার সর্ব প্রথম ঐতিহ্যবাহী বৃহৎ বস্ত্রকল কুষ্টিয়া মোহিনী মিল বন্ধ হয়ে যায়।
১৯৯২ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া কুষ্টিয়া সার্কিট হাউসে এক মতবিনিময় সভায় মিলটি চালু করার আশ্বাস দেন। এরপর ১৯৯৬ সালে তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও কুষ্টিয়া এসে একই ঘোষণা দেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা অনুযায়ী ২০১০সালে মিলটি চাল হলেও কিছু দিনের মাথায় আবার তা বন্ধ হয়ে যায়।
প্রায় ১০০ বিঘার উপর প্রতিষ্ঠিত মোহিনী মিলের বয়ন বিভাগে ৫৩৭ টি তাঁত স্পিনিং, ১৯ হাজার টাকু, এছাড়াও সুতা বিভাগ, ব্লুরুম, কাটিং, ডরিং, স্লাবিং, ক্যালেন্ডার, ওয়েলডিং, ইঞ্জিনিয়ারিং, সাইজিং, ড্রয়িং, রিসিংসহ বিভিন্ন বিভাগ নষ্ট হতে বসে। মিলের গাড়ীগুলোসহ সকল যন্ত্রাংশ কালের সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে।
পরবর্তীতে ১৯৮৬ সালে ১৬ ফেব্রুয়ারী সরকার নজরুল গংদের কাছে মিলটি হস্তান্তর করেন। কিন্তু তারা অগ্রণী ব্যাংকের ঋণের টাকা দিতে ব্যর্থ হলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ মামলা দায়ের করেন। ১৯৯১ সালে ওই মামলাটি করা হয়।
ব্যাংক সূত্র মতে, গত ২০১১ সালে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত অগ্রণী ব্যাংক কুষ্টিয়া বড় বাজার শাখা জারিকৃত মামলায় ঋণ দেখায় ২ শত ৫৮ কোটি ৭১ লাখ ১৯ হাজার ১ শত ৬১ টাকা। কিন্তু মিল কর্তৃপক্ষ ওই টাকা না দেওয়ায় ২৫ আগষ্ট ২০১৩ সাল পর্যন্ত ১৬% হারে সুদসহ টাকা হয়েছে ৪১ কোটি ৩৯ লাখ ৩৬ হাজার টাকা। যা মুলসহ ৩শত কোটি ১০ লাখ টাকা। এ পরিমাণ ব্যাংকে ঋণ থাকার পরও মিলটি বিক্রির ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। এ নিয়ে ব্যাংক কর্মকর্তারা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকেও জানিয়েছে।
সুত্রে জানা গেছে, গত ২২ জুলাই আকা/ফা-শাহ মাখদুম-১০৩/১৯১৯/১৩ এর পত্র অনুযায়ী মিলের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরা হয়। সেখানে গত ২৪ জুলাই অত্র ডিভিশনের অফিস নোট-ল/৮৫১/১৩ এর মাধ্যমে আইনগত মতামতের জন্য বাংকের সার্বক্ষণিক আইন উপদেষ্টা শাহজাহান মজুমদারকে জানানো হয়। ওই পত্রে উল্লেখ করা হয় কুষ্টিয়া বড় বাজার অগ্রণী ব্যাংক শাখার ঋণ গ্রহীতা প্রতিষ্ঠান মেসার্স শাহ মাখদুম টেক্সটাইল মিল খেলাপী হলে ব্যাংক অর্থঋণ আদালতে মোকদ্দমা দায়ের করে ডিক্রিপ্রাপ্ত হন ও ডিক্রিজারী মোকদ্দমা দায়ের করেন। সর্বোপরি অর্থজারী মোকদ্দমার তফসীল ভুমি আদালত কর্তৃক ক্রোকাবদ্ধ। বর্তমানে ব্যাংক কর্তৃপক্ষের অভিযোগ কতিপয় ব্যক্তি মিলের মধ্যে অবৈধভাবে অবস্থান করছে এবং মিল নিয়ে চক্রান্ত করছেন। ব্যাংকের ঋণের টাকা আদায় না হওয়া পর্যন্ত মিলটি যাতে বিক্রি না করতে পারে সে বিষয়ে ব্যাংক কর্তৃপক্ষও আইনগত ব্যবস্থা গ্রণের দাবী জানান।
সুত্রমতে, এক শ্রেনীর কুচক্রী নেতৃবৃন্দ এ মিলটি বিক্রির চক্রান্ত করছে বলে অভিযোগ করা হয়। বর্তমানে মিলটি ক্রয়ের জন্য ঢাকার মেসার্স এনারগোর্টিক লিমিটেড এর মালিক আরিফুর রহমান চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানানো হয়েছে।
জেলার সুশীল সমাজের অভিযোগ, সরকারী নিয়মনীতি উপেক্ষা করে এ মিলের যন্ত্রাংশ চুরি করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ইতিপূর্বে কিছু কুচক্রীদের কারণেই এ মিলটি ধ্বংস করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখন পুনরায় কিছু কুচক্রী ব্যক্তি এ কাজটি করছে। কুষ্টিয়া অগ্রণী ব্যাংকের ৩ শত কোটি ১০ লাখ টাকা ঋণ আদায় না করে এ ধরনের চক্রান্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণেরও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
সুত্রমতে, পাট ও বস্ত্রমন্ত্রণালয়ের উপসচিব ও লিকুইডেটর স্বাক্ষরিত এক পত্রে জানানো হয় এনারগোর্টিক লিমিটেড এর মালিক আরিফুর রহমান এর সাথে মোহিনী মিলস লিঃ এর স্কার্ফ ডেলিভারী ও মিলের দখল বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ওই চুক্তিতে মিলের মূল্য বাবদ পরিশোধিত ৪৮ কোটি ৪৯ লাখ ৭৩ হাজার ৫ শত ৫৩ টাকা টাকার মধ্যে ইতিমধ্যেই পরিশোধিত ১০ কোটি টাকা এবং বাকী টাকা পত্র জারীর পর হতে প্রতি ৩ মাস অন্তর সমান ৪টি কিস্তিতে পরিশোধ করার জন্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।
এর উপর ভিত্তি করেই মিলটি দখলের চেষ্টা করা হচ্ছে বলে ওই সুত্রটি দাবী করেছে।
সুত্রমতে, মিলটির ভীতরের যন্ত্রাংশ চুরি করে কেটে পাচারের চক্রান্ত থেমে নেই। মিলের অনেক যন্ত্রাংশ কেটে সাবাড় করা হয়েছে। যে কোন মুহুর্তে মিলের ওইসব যন্ত্রাংশ পাচার হয়ে যেতে পারে।
এদিকে মিলটি বন্ধ হওয়ায় কয়েক হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে। এ সরকার ক্ষমতায় আসার পর অনেকের মাঝে আশার সঞ্চার হলেও তা নিরাশায় পরিণত হতে বসেছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন