বৃহস্পতিবার, জানুয়ারী ১৭, ২০১৩

পাঠ্য বই মুদ্রণেও বিদেশপ্রীতি!

 ১০০ কোটি টাকার কাজ চলে গেছে দেশের বাইরে

ডেস্ক রিপোর্ট : দেশের মুদ্রণশিল্পের সক্ষমতা সত্ত্বেও বিদেশ থেকে পাঠ্য বই ছাপিয়ে আনছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। এতে একদিকে যেমন বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় হচ্ছে, অন্যদিকে দেশের মুদ্রণ ও কাগজশিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ দুই খাতে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মুদ্রণশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এনসিটিবি গত বছর মাধ্যমিক, প্রাথমিক, দাখিল ও এবতেদায়ির বইসহ প্রায় ২৭ কোটি পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ করেছে। এর মধ্যে প্রাথমিক স্তরের ২৪ কোটি বই ছাপানো হয়েছে দেশে। বাকি তিন কোটি বই ভারত থেকে ছাপিয়ে আনা হয়েছে। বাংলাদেশ মুদ্রণশিল্প সমিতির (বিএমএমএস) সাধারণ সম্পাদক শাহ আলম বলেন, স্থানীয়ভাবে এ তিন কোটি বই মুদ্রণের সক্ষমতা রয়েছে। তবু বিশ্বব্যাংকের চাপে সরকারি এ সংস্থাটি তিন কোটি বই ছাপানোর জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে। কালের কন্ঠ। শাহ আলম বলেন, স্থানীয়ভাবে এ বই মুদ্রণের জন্য আমরা মানববন্ধন করেছি। অনশনসহ নানা রকম কর্মসূচি পালন করেছি। কিন্তু এনসিটিবি চেয়ারম্যান বিশ্বব্যাংকের অজুহাত দেখিয়ে আমাদের এই দাবি আমলে নেননি। পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের কর্মকর্তারা জানান, গত বছর ১১ কোটি প্রাথমিকের বই ছাপাতে মোট খরচ হয়েছে ৩৪০ কোটি টাকা। এর মাত্র ২০ শতাংশ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। বাকি টাকা দেওয়া হয়েছে সরকারি কোষাগার থেকে। শিক্ষা খাতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বেশ কিছু প্রকল্প চালু রয়েছে। এর একটি হচ্ছে প্রাইমারি এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (পিইডিপি)। বিশ্বব্যাংকসহ আরো কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থার অর্থায়নে পরিচালিত
এ প্রকল্পটির এখন তৃতীয় পর্যায় চলছে। এ প্রকল্পের আওতায় পাঠ্যপুস্তক ছাপানোর কার্যক্রম রয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে পাঠ্যপুস্তক দেশের বাইরে থেকে ছাপিয়ে আনার কোনো পূর্বশর্ত আছে কি না তা বিশ্বব্যাংক থেকে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। দেশীয় মুদ্রণশিল্পকে উৎসাহ প্রদানের জন্য পাঠ্যপুস্তক আমদানিতে ১২ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য শুল্কসহ আমদানিকারকদের মোট ২০.৪৩ শতাংশ রাজস্ব দিতে হয়। কিন্তু এনসিটিবি এ রাজস্ব আন্তর্জাতিক দরপত্রের সঙ্গে যোগ না করেই সর্বনিম্ন দরদাতা নির্ধারণ করে। ফলে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে কাজ পেয়ে যায়। অথচ এটা যোগ করে সর্বনিম্ন দরদাতা নির্ধারণ করা হলে দেশীয় প্রতিষ্ঠানই কাজ পেত। ফলে প্রায় ১০০ কোটি টাকার মুদ্রণকাজ দেশের বাইরে চলে গেছে। এতে যেমন স্থানীয় মুদ্রণশিল্পের সঙ্গে জড়িতরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রার অপচয়ও হয়েছে। দেশীয় মুদ্রণকারীদের মাধ্যমে বই ছাপা হলে প্রায় ২০ কোটি টাকার অতিরিক্ত আমদানি শুল্কও দিতে হতো না বলে জানান স্থানীয় মুদ্রণ ব্যবসায়ীরা। মুদ্রণশিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক বলেন, বিদেশ থেকে বই মুদ্রণের মাধ্যমে বাংলাদেশ মুদ্রণশিল্প আইন ১৯৭৩ লঙ্ঘন করা হয়েছে। প্রতিবেশী দেশের একটি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ সুবিধার বিনিময়ে কাজ পাইয়ে দিতে এ অনিয়ম করা হয়েছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘আমরা ২৪ কোটি বই মুদ্রণ করতে পারলে বাকি তিন কোটি বইও করতে পারতাম।
এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. মোস্তফা কামাল উদ্দিন জানান, এনসিটিবি ২০১৩ সালে ২৬ কোটি ১৮ লাখ ৯ হাজার ১০৬টি পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ করেছে। এর মধ্যে তিন কোটি ৩০ লাখ ৮৫ হাজার ৯০টি বই মুদ্রণ করেছে আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে। বই ছাপানো বাবদ মোট খরচ হয়েছে সাত শ কোটি ৪১ লাখ টাকা। আন্তর্জাতিক দরপত্র প্রসঙ্গে চেয়ারম্যান বলেন, সঠিক সময়ে ছাত্রছাত্রীদের কাছে বই পৌঁছে দিতে এ বছর আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। ফলে দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হয়েছে এবং অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক কম দামে বই মুদ্রণ সম্ভব হয়েছে। এই আন্তর্জাতিক দরপত্রে ১৪টি দেশ অংশগ্রহণ করে। সর্বনিম্ন দরদাতা হয়ে প্রাথমিক বই মুদ্রণের কাজ পেয়েছে ভারত। বিদেশি বইয়ের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে আমদানি শুল্কসহ। এতে বিদেশি দরদাতাকে কোনো বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়নি। দেশের কাগজশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, সরকারি নীতিমালা, সদিচ্ছার অভাব এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ এনসিটিবির কিছু কর্মকর্তার অনীহার কারণে কর্ণফুলী পেপার মিলসহ ধ্বংস হতে বসেছে দেশের উদীয়মান কাগজশিল্প। তাঁদের অভিযোগ, দেশি কাগজের কাঁচামাল আমদানিসহ নানা পর্যায়ে উচ্চমাত্রায় শুল্ক চাপিয়ে শুল্কমুক্তভাবে বিদেশি কাগজ আমদানি উৎসাহ করা হচ্ছে। ফলে বিদেশি কাগজের সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়ছে দেশের কাগজশিল্প। এ ক্ষেত্রে সরকারি পেপার মিলগুলোর অবস্থাই বেশি খারাপ। এরই মধ্যে সরকারি দুটি পেপার মিল বন্ধ হয়ে গেছে, কর্ণফুলী কাগজ কলটিও চলছে ধুঁকে ধুঁকে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন