শনিবার, ফেব্রুয়ারী ০৯, ২০১৩

সাড়ে পাঁচ’শ বছরের খোকসার কালীপূজা একাল-সেকাল

অতি জমকালো বৃহত্তর কুষ্টিয়ার সর্ববৃহৎ এ মেলায় পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পূর্ণাথী ও ভক্তবৃন্দ এসে সাড়ে সাত হাত লম্বা কালী প্রতীমাকে ভক্তি ও প্রণাম করার পাশাপাশি দেবী কালীর উৎসর্গে বলিকৃত পাঁঠা ও মহিষের মাংশ খেয়েও তৃপ্তিবোধ করে। সাড়ে পাঁচ”শত বছরের ঐতিহ্যবাহী কালীপূজার ইতিহাস নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদনে বিস্তারিস্ত জানাচ্ছেন আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক মনিরুল ইসলাম মনি--
উপমহাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়সহ বর্ণবৈষম্যহীন মানুষের অন্যতম সনাতনী ভক্তির স্থান ও ধর্মীয় পর্যটন কেন্দ্র কুষ্টিয়ার খোকসার কালীপূজা মন্দিরের সাড়ে পাঁচ’শ বছরের ঐতিহ্যবাহী পূজা ও মেলাকে ঘিরে স্থানীয় সব শ্রেণী পেশার মানুষের মেলবন্ধনে অন্যরকম এক আমেজের সৃষ্টি হয়। অত্র এলাকার মানুষ যে সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাসী না সেটিই চোখে আঙ্গুল দিয়ে প্রমাণ করে দেয় মেলার হিন্দু-মুসলিম ঐক্যকে। পৌষের আমাবশ্যা থেকে পূজার আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে সাড়ে সাত হাত লম্বা বিশাল দেহের দৃষ্টিনন্দন কালী প্রতীমা মেলার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। কালী মন্দিরের শ্রী বাড়াতে নতুন করে যোগ হয়েছে কেন্দ্রীয় মহাশ্বসান। অতি জমকালো বৃহত্তর কুষ্টিয়ার সর্ববৃহৎ এ মেলায় পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পূর্ণাথী ও ভক্তবৃন্দ এসে সাড়ে সাত হাত লম্বা কালী প্রতীমাকে ভক্তি ও প্রণাম করার পাশাপাশি দেবী কালীর উৎসর্গে বলিকৃত পাঁঠা ও মহিষের মাংশ খেয়েও তৃপ্তিবোধ করে।
খোকসার ঐতিহ্যবাহী কালীপূজার সঠিক কোন ইতিহাস কোথাও পাওয়া না গেলেও বর্তমানের পূজারী শ্রী প্রবোধ কুমার ভট্রাচার্যের সপ্তদশ ঊর্ধ্বতন পুরুষ রামাদেব তর্কলংকার এ পূজার প্রথম পূজারী ছিলেন বলে তিনি দাবি করেন। এ থেকেই অনুমান করা হয় খোকসার কালীপূজার বয়স প্রায় সাড়ে পাঁচ’শ বছর। আত্মপ্রচার বিমূখ এ তান্ত্রিক সাধু গড়াই নদীর তীরে খোকসা নামক এক জাতীয় গাছে বেষ্টিত জন মনুষ্যহীন জঙ্গালাকীর্ণ স্থানে কালীপূজা আরম্ভ করেন বলে লোক মুখে শোনা যায়। কার্যত খোকসা উপজেলার নামকরণ উল্লেখিত ‘খোকসা’ নামক বিশেষ এ গাছ থেকেই করা হয়েছে। বর্তমান পূজারীর পূর্বপুরুষ জনৈক পন্ডিতকে একদিন বিশালাকৃতির একটি মহিষ আক্রমণ করলে তার হাতে থাকা চন্ডিগ্রস্থ্য ছুঁরে মহিষটি বধ করেন। এ ঘটনা নলডাঙ্গার রাজার কর্ণগোচর হওয়ার পর আলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন এ ব্রাহ্মণ জনৈক জমিদার পুত্রকে সাপে কাটলে চিকিৎসার জন্য তার কাছে নেওয়া হয়। রোগীকে কালীর পদতলে শুইয়ে দিয়ে গভীর ধ্যান-সাধনার মাধ্যমে জমিদার যুবাকে সুস্থ্য করে তোলেন তান্ত্রিক এই সাধু। খবর পেয়ে জমিদার কালীর প্রতি ভক্তি আল্পুত করে এবং তান্ত্রিক সাধুর নির্দেশ মতে সাড়ে সাত হাত দীর্ঘ কালী মূর্তি নির্মাণ করে মাঘি আমাবশ্যার তিথিতে প্রথম কালীপূজা করেন। তারপর থেকেই খোকসার কালীপূজা মন্দিরে ধারাবাহিকভাবে বছরের প্রতি মাঘি আমাবশ্যার তিথিতে পূজা হয়ে আসছে। কালীপূজার শুরু থেকেই ক্রোধের প্রতীক হিসেবে মহিষ ও পাঁঠা বলির প্রথা চালু হয়। প্রথম দিকে পাঁঠা বলির সংখ্যা ছিল অনির্ধারিত। বার্ষিক পূজার দিনে প্রথম প্রহরে চন্ডি পাঠান্তে একটি পাঁঠা বলি দেয়া হতো। দিনের শেষ প্রহরে দেবীকে আসনে তোলার পর নড়াইলের জমিদার রতন বাবুদের পাঁচ শরিকের জন্য পাঁচটা পাঁঠা অতঃপর নলডাঙ্গার রাজার পাঠানো মহিষ বলি হত। তারপর জোড়া পাঁঠা বলি দেওয়া হত শিলাইদহের জমিদারি ষ্ট্রেট এর সম্মানে। মাঘি সপ্তমীর পূজা ও মেলা পর্যন্ত চলতো ভক্তদের মানসার জন্য আনা পাঁঠা বলি। ক্রোধের পথিক মহিষ ও পাঁঠা বলির এ প্রথা সেই রাজা-জমিদারি আমলের রেওয়াজে আজও প্রচলিত রয়ে গেছে। জমিদার বাবুর পরিবারের চার শরিকের জন্য ১৪’শ বিঘা এবং কালীপূজার সঙ্গে সম্পৃক্ত কাঠামো তৈরীর মিস্ত্রি, ধোপা, নাপিত, মালাকার, ভুঁইমালী, ঢাকী ও পরিস্কার-পরিচ্ছন্নকারীকে চাকরানা হিসেবে ১২ বিঘা করে জমি নিস্কর ভোগের সুযোগসহ বার্ষিক পূজার সাত দিন দপাম্বিতা খরচ নির্বাহের জন্য ১৬ বিঘা জমি দান করেন।
কালের স্বাক্ষী বহনকারী বিশাল এক জোড়া বট ও পাকুর গাছ বেষ্টিত প্রাত্যহিক পূজা মন্দির। এখানেই রয়েছে নলডাঙ্গার রাজা ইন্দুভূষণ দেব রায় কর্তৃক গড়াই নদী থেকে পাওয়া বৌদ্ধ আমলের নিদর্শন কৃষ্ণবর্ণের প্রস্তর খন্ড। এ প্রস্তর খন্ডের গঠন অনেকটা চৌকির মতো। কৃষ্ণবর্ণের প্রস্তর খন্ডটিকে ঘিরে সারা বছরই উৎসাহ ও উদ্দীপনায় পূজা করা হয়। ২৭ ইঞ্চি লম্বা ও ৪ ফুট চওড়া পিতলের পাত দিয়ে তৈরী শিব ঠাকুর পূজার পাট আসনও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আগের পূজা মন্দিরটি প্রমত্তা গড়াই নদীতে বিলীন হয়ে যাওয়ায় ১৩৪১ বঙ্গাব্দে পূজা মন্দিরটি বর্তমান স্থানে সরিয়ে আনা হয়। বার্ষিক পূজা মন্দিরে প্রতি বছর মাঘি আমাবশ্যার তিথিতে সাড়ে সাত হাত লম্বা কালী মূর্তিসহ সাড়ে বার হাত দীর্ঘ মাটি ও খড় দিয়ে তৈরী কালীমূর্তি পূজান্তে বিসর্জন দেয়া হয় গড়াই নদীতে। এখানে নির্মাণ করা হচ্ছে নাট মন্দির, বার্ষিক কালীপূজা মেলায় আগত পূণার্থী, দর্শণার্থীদের জন্য সাময়িক বিশ্রামাগার ও পূজা কমিটির কার্য্যালয়। মন্দিরের সামনের রাস্তা চলে গেছে সোজা জানিপুর বাজারের দিকে এবং পশ্চিমের গড়াই নদী পর্যন্ত বিস্তৃত মাঠ। এখানেই বসে সাড়ে পাঁচ’শ বছরের ঐতিহ্যবাহী মেলা। প্রতি বছর একই তিথিতে প্রচলিত নিয়মে কালীপূজা উপলক্ষে মেলা হয়ে আসছে। মাঘি আমাবশ্যার এক মাস আগে থেকে শুরু করা হয় পূজা ও মেলার যাবতীয় প্রস্তুতি। চলে কালীর মূর্তি বানানোর প্রক্রিয়া। প্রথমে কদম কাঠ ও খড় দিয়ে তৈরী করা হয় কাঠামো। পর্যায়ক্রমে চলে মাটি মেশানো ও রং করা। বিশাল দেহের দৃষ্টি নন্দন কালী প্রতিমা তৈরীর কাজ বংশ পরমপরায় করে আসছেন স্থানীয় প্রতীমা শিল্পী সুকুমার বিশ্বাস, নিমাই বিশ্বাস ও তাদের সহযোগীরা। কালী মূর্তিকে ঘিরেই পূজা ও মেলার আয়োজন। এখন সাত দিন পর্যন্ত মেলা হয়ে থাকে, জমিদার আমলে এখানে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে মেলা চলতো।
রাজা-জমিদার প্রথা বিলুপ্তির পর খোকসার কালীপূজা ও গ্রামীণ মেলার প্রসার বহুলাংশে কমে গেছে। রাজা-জমিদার শাসন পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে কালীপূজা মন্দির ও গ্রামীণ মেলার সাড়ম্বর বাড়াতে নেওয়া হয়েছিল নানা যুগোপযোগী উদ্যোগ। কিছু সীমাবদ্ধতা আর অর্থনৈতিক টানাপড়েনে সেগুলোর পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়ে ওঠেনি আর। প্রমত্তা গড়াই নদীর অব্যাহত ভাঙনে নবাবী আমলে স্থাপত্য মন্দিরটি ১৩৪০ বাংলা সালে নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার এক বছর পরেই ১৩৪১ বঙ্গাব্দে স্থানীয় গুটিকয়েক হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রচেষ্টায় কালী মন্দিরটি নতুন করে তৈরী করা হয়। ইতিমধ্যে কালীবাড়িকে ঘিরে নেওয়া হয়েছে বেশ কিছু অবকাঠামো উন্নয়ন মূলক উদ্যোগ। নিত্য পূজার প্রাচীন আমলের চার-চালা ঘরটি গড়াই গর্ভে বিলীন হওয়ার পর নির্মিত বিশাল মন্দিরটি আজ শোভা বর্ধণ করছে। তবে নাট মন্দির নির্মাণধীন থাকলেও আলোর মুখ দেখেনি ধর্মীয় ও সেবায়েত আশ্রমটি। কালীপূজা মেলা স্থানান্তর করে ব্যাপক সংস্কার কর্মসূচী গৃহীত হয়। বর্তমান পূজা কমিটিসহ এলাকার সুধীজনেরা দায়িত্ব গ্রহণের পর ২৮ অগ্রহায়ণ ১৩৮৯ বঙ্গাব্দের আমাবশ্যার তিথিতে বার্ষিক পূজা মন্দিরটি পাকাকরণের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনসহ সংস্কৃতি চতুম্পাট ভবন নির্মাণের মাধ্যমে কাব্য, ব্যকরণ, ন্যায় ও স্মৃতি বিষয়ে শীক্ষাদান ধর্মীয় পাঠাগার, প্রাত্যহিক ও বার্ষিক পূজার সময়ে আগত ভক্তদের জন্য সেবায়েত ভবন ও কালীবাড়ির সীমানা প্রাচীর নির্মাণের ব্যাপক কর্মসূচী গৃহীত হলেও নানাবিধ সমস্যা থাকায় শুধুমাত্র বার্ষিক পূজা মন্দির, সংস্কৃতি চতুষ্পাট ভবন ও দর্শনার্থীদের বিশ্রামগার তৈরীর কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
অতি পরিতাপের বিষয় যে আজ অব্দি সাড়ে পাঁচশ বছরের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহ্যমন্ডিত খোকসা কালীপূজা মন্দির ও ধর্মীয় পর্যটন কেন্দ্রটি সম্পর্কে কোন ইতিহাস রচনা করা হয়নি। তবে বিশিষ্ঠ লালন ও নজরুল গবেষক, প্রাবন্ধিক, খোকসা ডিগ্রি কলেজের সাবেক উপাধ্যক্ষ রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস ‘খোকসার কালী’ নামের তথ্যসমৃদ্ধ একটি বই রচনা করলেও সেটি সংরক্ষণের কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। উল্লেখ্য বইটিতে খোকসা উপজেলার নামের ইতিহাসও খুব স্পষ্টভাবে স্থান পেয়েছে। একটু সহযোগিতা কিংবা সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সু-বিবেচনায় আসলে খোকসার কালীপূজা মন্দিরটি একটি আদর্শ ধর্মীয় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে পারে, সেই সাথে একটি সম্ভাবনাময় ধর্মীয় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে আতœপ্রকাশ করতে পারে খোকসার প্রাচীনতম এই কালী মন্দিরটি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন