শনিবার, ফেব্রুয়ারী ০৯, ২০১৩

৩০ বছর ধরে বন্ধ কুষ্টিয়ার মোহিনী মিল

কুদরতে খোদা সবুজ : বিগত প্রতিটি সরকার কুষ্টিয়ার বিখ্যাত বস্ত্রকল মোহিনী মিল চালু করার প্রতিশ্র“তি দিলেও প্রায় ৩০ বছরে মিলটির ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। ফলে মিলের প্রায় ৩ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছেন। মিলটি বন্ধ থাকায় একদিকে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে চুরি হয়ে যাচ্ছে কারখানার মূল্যবান যন্ত্রাংশ।
মিলের পুরোনো শ্রমিক-কর্মচারীরা জানান, ১৯০৮ সালে কুষ্টিয়ার গড়াই নদীর তীরে ৩৩ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় একটি বস্ত্রকল। প্রতিষ্ঠাতা মোহিনী মোহন চক্রবর্তীর নামে প্রতিষ্ঠানটির নাম রাখা হয় মোহিনী মিল। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর মিলটি শত্রু সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত করে তৎকালীন সরকার এর পরিচালনার দায়িত্ব দেন ইস্ট পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের (ইপিআইডিসি) হাতে। অন্যদিকে মিলের মালিক মোহিনী মোহন চক্রবর্তী মালিকানা হারিয়ে দেশ ত্যাগ করে ভারতে চলে যান। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে সরকার অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠানের মতো মোহিনী মিলও জাতীয়করণ করে। কিন্তু এরপর থেকেই কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর দুর্নীতি ও কর্তৃপক্ষের অবহেলায় লোকসান দিতে দিতে অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় মোহিনী বস্ত্রকল। জাতীয়করণের পর থেকে ১৯৭৭-৭৮ অর্থবছর পর্যন্ত মিলটির লোকসান দাঁড়ায় প্রায় ১৮ কোটি টাকা। মিলটিকে বাঁচানোর জন্য সরকার ১৯৭৮ সালে যুক্তরাজ্য সরকারের সহায়তায় মিলের একাংশে বিএমআরই (ব্যালেন্সিং মডার্নাইজিং রিকনস্ট্রাকটিং ইঞ্জিনিয়ারিং) প্রকল্প স্থাপন করে। এ প্রকল্প থেকে প্রতিদিন ১৫ বেল সুতা উৎপাদন হলেও মিলের পুরনো অংশে সমস্যা থেকেই যায়। এক পর্যায়ে মোহিনী মিলটিকে পরিচালনার অনুপযুক্ত ঘোষণা করে ১৯৮২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি মিলটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর শুরু হয় ব্যাপক শ্রমিক অসন্তোষ। প্রায় তিন বছর লাগাতার আন্দোলনের পর ১৯৮৪ সালে ২৪ সেপ্টেম্বরর ৫০ কোটি টাকারও বেশি মূল্যের মোহিনী মিল অর্ধেক দামে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। মাত্র ২৫ কোটি ২৬ লাখ টাকায় মিলটি কিনে নিয়ে নতুন মালিক নজরুল ইসলাম এর নামকরণ করেন শাহ মখদুম টেক্সটাইল মিল। ১৯৮৫ সালের ৩১ জানুয়ারি মাত্র ১০০ শ্রমিক নিয়ে মিলটি আবার চালু হয়। অভিযোগ রয়েছে, নজরুল ইসলাম বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকের কাছ থেকে এ মিলের জন্য মোটা অংকের ঋণ নিলেও সেই অর্থ তিনি মিল পরিচালনায় ব্যয় করেননি। ফলে শ্রমিকদের ১০ মাসের বেতন বাকি পড়ে যায় এবং পুনরায় শ্রমিক অসন্তোষ শুরু হয়। ১৯৮৭ সালের ১৫ অক্টোবর মিলের পুরনো অংশটি লে-অফ ঘোষণা করা হয় এবং ১৯৮৮ সালে মিলটি সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। এ পরিস্থিতিতে নতুন ক্রেতার মাধ্যমে মিলটি চালুর উদ্দেশ্যে সরকার ১৯৯০ সালের ১৫ আগস্ট আবার মিলটির দখল নেয়। মিলটি বিক্রির উদ্দেশ্যে ১৯৯১ সালের ২০ জানুয়ারি সংবাদপত্রে দরপত্র দেওয়া হয়। কিন্তু আগের মালিক ও ব্যাংকের মামলা কারণে সেই দরপত্র প্রক্রিয়া স্থগিত হয়ে যায়।
মিলের পুরনো কর্মীরা জানান, লোকসানের কারণে মিলটি বারবার অচল হয়ে পড়লেও এ মিলের লাভের টাকা দিয়েই ব্রিটিশ আমলে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে দ্বিতীয় মোহিনী মিল ও অন্নপূর্ণা কটন মিল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মিলের সাবেক মালিক মোহিনী মোহন চক্রবর্তী। প্রথমবার মিলটি বন্ধের পর স্থানীয় একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠী ছোট ছোট একাধিক শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক বনে যান। ঐহিত্যবাহী মোহিনী মিল বন্ধ থাকায় একদিকে সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অন্যদিকে জাতীয় এই সম্পত্তিটিও ধ্বংস হওয়ার পথে। ইতিমধ্যে মিলের পিতল, লোহা, ইলেকট্রিক মোটর, যন্ত্রাংশ ও মূল্যবান দ্রব্য পাচার হয়ে গেছে। বিগত মালিক সের দরে বিক্রি করে দিয়েছেন মিলের নথিপত্র। কয়েক বছর আগে মিলের চিমনিটিও ভেঙে পড়েছে। মিলটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তিন হাজার শ্রমিক-কর্মচারী পরিবার-পরিজন নিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন যাপন করছেন। বেঁচে থাকার তাগিদে রিকশা চালনা বা ভিক্ষাবৃত্তি শুরু করেছেন কেউ কেউ। অভিযোগ রয়েছে, কর্মহীন শ্রমিকদের একটি অংশ কুষ্টিয়ার সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েছে। মোহিনী মিল সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক বলেন, 'বিগত সব সরকারই মিলটি আবার চালু করার আশ্বাস দিয়েছে। কিন্তু ৩০ বছরেও তা কার্যকর হয়নি। বরং মোহিনী মিল পাহারা দেওয়ার নাম করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক শ্রেণীর সদস্য মিলের সব সম্পদ লুটপাট করে বিক্রি করে দিচ্ছে। অন্যদিকে আমরা, শ্রমিকরা ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করছি। কুষ্টিয়া চেম্বার অ্যান্ড কমার্সের সভাপতি বলেন, 'দীর্ঘদিনেও মিলটি চালু না হওয়ায় আমরা সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছিলাম, মোহিনী মিলের জায়গায় কুষ্টিয়ার দ্বিতীয় শিল্পনগরী স্থাপন করা হোক। বর্তমান সরকারের কাছেও আমরা একই দাবি জানাচ্ছি।
প্রসঙ্গত ১৯৯২ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া কুষ্টিয়া সার্কিট হাউসে এক মতবিনিময় সভায় মিলটি চালু করার আশ্বাস দেন। এরপর ১৯৯৬ সালে তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও কুষ্টিয়া এসে একই ঘোষণা দেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন