বুধবার, ফেব্রুয়ারী ২০, ২০১৩

কুষ্টিয়ায় সম্ভাবনাময় হস্তশিল্প প্রতিষ্ঠান আত্মনির্ভরশীল ছয় সহস্রাধিক নারী

ষ্টাফ রিপোর্টার : কাকডাকা ভোরে সবাই যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, তখন সুখজান নেসা বসেছেন ঘরের মেঝেতে কাঠের পাটাতনে শাড়ি কাপড় নিয়ে। শাড়ির চার কোনায় বেঁধে বাহারি রং-বেরঙের পাথর বসিয়ে তৈরি করছেন নান্দনিক ও মনোমুগ্ধকর নকশা। এখনও অনেক কাজ বাকি। তাকে সূর্য ওঠার আগেই পুরো শাড়ির কাজ শেষ করতে হবে। ঝটপট হাত চালান সুখজান নেসা। এক এক করে আরও কয়েকজন এসে সুখজানের কাজে সহযোগিতা করতে থাকে। নিজের উদ্ভাবিত কৌশলে বিভিন্ন রঙের বুটিক তৈরির অর্থই সুখজানের পরিবারের জীবন ধারণের প্রধান অবলম্বন। কুষ্টিয়ার ৬টি উপজেলায় ব্যক্তি প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছে শতাধিক হস্তশিল্প প্রতিষ্ঠান। এসব সম্ভাবনাময় হস্তশিল্প প্রতিষ্ঠানে ৬ সহস্রাধিক নারী প্রশিক্ষিত হওয়ার পাশাপাশি এখন রীতিমত আত্মনির্ভরশীল। মাত্র এক দশকের ব্যবধানে বেশ বদলে গেছে এখানকার নারীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার চালচিত্র। আর এ পরিবর্তন একটি অভাবী দরিদ্র জনপদ থেকে নারীদের আত্মকর্মসংস্থানের জনপদে পরিণত করেছে। হস্তশিল্পের বর্ণিল আভায় আলোকিত এখন এখানকার বিভিন্ন জনপদ। এক সময়ের অসচ্ছল গৃহিণী রুমা জানান, তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে দিনমজুর স্বামী পরান ম-লের সামান্য উপার্জনে তাদের পরিবারে দুঃখ-কষ্টের সীমা ছিল না। এই দুর্বিষহ জীবনযাপনে চায়না ও ভারতের তৈরি জর্জেট, সিল্কের থান কাপড়ের ওপর পাথর, চুমকি ও পুঁতি বসানো কাজ শুরু করি। এরপর রুমাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। জেলার কুমারখালী উপজেলার সাদিয়া বুটিক হাউসের কারিগর রীনা জানান, অন্যান্য বছরের মতো এ বছরও সহস্রাধিক কাজের অর্ডার পেয়েছি। তবে আধুনিক মেশিনের তৈরি ভারতীয় লেইস বাজারে আসার কারণে পাথরের তৈরি বুটিকের চাহিদা তুলনামূলক কমে গেছে। তারপরও শৌখিন রমণীরা তাদের পছন্দসই শাড়ি বা বোরকা পছন্দ করেন। তিনি জানান, এখানে মেশিনে কোনো কাজ করা হয় না। গ্রাহকরা তাদের পছন্দমত শাড়ি বা বোরকার কাপড় এনে দেন। আমরা শুধু ক্যাটালগ দেখে বিভিন্ন ডিজাইনের নকশা ও পাথর বসিয়ে কাজ করি। নকশার কাজে ওয়েট লেইস, মাখন, লেদার জর্জেট, পাথর, জরি, চুমকি, মাল্টি পুঁতি ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। কাপড় ও কাজের মান অনুযায়ী দাম নির্ধারণ করা হয়। যেমন ছফুরা সিল্ক এক কাপড়ের শাড়ি সর্বনিম্ন ৩৫০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৫০০ টাকা, আবার ডিজাইন ভেদে ১২ হাজার টাকাও একেকটি শাড়ির দাম পড়ে। ১৫ বছর ধরে পাথরের ওপর বুটিকের কাজ করা শিল্পী রুমা জানান, ঈদকে সামনে রেখে ৬ মাস আগে থেকে কাজ শুরু করা হয়। গ্রাহকরা এসে কাপড় দিয়ে অর্ডার দিয়ে যান। কুষ্টিয়া বুটিকস পল্লীর সাদিয়া ফ্যাশন, রুমী ফ্যাশন ও রিন্তু ফ্যাশনের কাজে যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। শুধু জেলার খোকসা-কুমারখালীতে ব্যক্তি প্রচেষ্টায় সাদিয়া, সোনালি, রানু, নদিয়া ক্রাফট, কুষ্টিয়া ও কুমারখালী হস্তশিল্প নামে অর্ধশতাধিক হস্তশিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এ অঞ্চলের মানুষ একসময় হস্তশিল্প বলতে বুঝতো পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে আমদানিকৃত মেশিন ও হাতে বিভিন্ন ধরনের নকশা করা শাড়ি এবং থ্রিপিস। কিন্তু এখন শাড়ি ও থ্রিপিসে বাহারি নকশায় কাজ হচ্ছে এখানে। এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত নারীরা জোর দাবি করে বলেন, তাদের কারখানায় কাজ করা শাড়ি ভারত থেকে আমদানি করা শাড়ির চেয়ে অধিক মানসম্পন্ন। এখানকার বুটিকস শিল্পীরা জানান, তারা পূর্বপুরুষের কাছ থেকে শেখা পদ্ধতিতে কাজ করে যাচ্ছেন। একটি শাড়ি বা বোরকায় পাথরের কাজ করতে ৩-৪ জন কারিগরের এক সপ্তাহ থেকে দুই সপ্তাহ পর্যন্ত লাগতে পারে। তবে তাদের অনেকে দুঃখের সঙ্গে বলেন, ভারত থেকে বিভিন্ন ডিজাইনের বাহারি লেইস বাজারে আসার কারণে তাদের ব্যবসায় মন্দার সৃষ্টি করেছে। এটা তাদের এ ব্যবসার জন্য হুমকি। তবে সরকারিভাবে ও অন্য কোনো মাধ্যমে সহযোগিতায় এগিয়ে এলে এ শিল্পকে আরও অনেক দূর এগিয়ে নেয়া যাবে। কুমারখালীর বরুড়িয়া গ্রামের নারী রীনা খাতুন ঢাকায় গার্মেন্টে কাজ করার পাশাপাশি হস্তশিল্প কাজের প্রশিক্ষণ নেন। একপর্যায়ে নিজের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে কুমারখালীর মির্জাপুরে সাদিয়া হস্তশিল্প নামে একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু করেন। প্রথমে নিজে শুরু করলেও পরে তার এক বান্ধবী দুর্গাপুর গ্রামের শিলাকে নেন তার এ ব্যবসার সঙ্গে। স্বল্প সময়ের মধ্যে শিলা নিজেও রপ্ত করে নেন এ কাজের কলাকৌশল। এ কাজে নেন নিজের বোন সোনালিকে। সোনালিও হয়ে ওঠে প্রশিক্ষিত। তারা গড়ে তোলেন সোনালি হস্তশিল্প নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠান। ধীরে ধীরে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে সাদিয়া ও সোনালি হস্তশিল্প প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানে নারীরা প্রশিক্ষণ গ্রহণের ৩ মাস পর্যন্ত পান সাড়ে ৮০০ টাকা করে প্রশিক্ষণ ভাতা। প্রশিক্ষণ শেষে একটি শাড়ির নকশা অনুযায়ী শাড়ি প্রতি ২ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৮ হাজার টাকা পেয়ে থাকেন। সোনালি হস্তশিল্পের পরিচালক রীনা জানান, একজন দক্ষ প্রশিক্ষিত নারী মাসে ৩ হাজার থেকে ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারেন। ঢাকার গাউছিয়া মার্কেটের আল হেলাল ফ্যাসন এখানকার হস্তশিল্পের নকশা করা শাড়ি বাজারজাত করছে। সোনালি হস্তশিল্পের শাড়ি মানসম্পন্ন হওয়ায় ব্যাপক চাহিদাও রয়েছে। এ শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে চায়না ও ভারতের তৈরি জর্জেট, সিল্কের থান কাপড় এবং পাথর, চুমকি, পুঁতি ও পাইপসহ ইত্যাদি দ্রব্যাদি। এসব শিল্প প্রতিষ্ঠানের উত্পাদিত বাহারি ডিজাইনের শাড়ি ভারতের তৈরি শাড়ির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে বাজারজাত করা হচ্ছে। হস্তশিল্প কাজে পিছিয়ে নেই প্রতিবন্ধী নারীরাও। দেখা গেছে, এসব হস্তশিল্প প্রতিষ্ঠানে শারীরিক প্রতিবন্ধী নারীরাও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে স্বাবলম্বী হতে চলেছেন। কুষ্টিয়ার ৬টি উপজেলার প্রায় ৬ সহস্রাধিক নারীর জীবন এখন হাসি-আনন্দ আর প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরা। তারা তাদের নিজস্ব প্রচেষ্টায় নিজ নিজ জীবনকে রাঙিয়ে দিয়েছেন সোনালি দিনের আলোয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন