বৃহস্পতিবার, ডিসেম্বর ০৪, ২০১৪

আজ খোকসা হানাদার মুক্ত দিবস

শত্র“মুক্ত হলেও দারিদ্রতামুক্ত হতে পারেনি মুক্তিযোদ্ধা নুরুল হক

মনিরুল ইসলাম মনি, খোকসা : আজ ৪ ডিসেম্বর, কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলা হানাদার মুক্ত দিবস। স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত বিজয়ের বেশ কয়েক দিন পূর্বেই ৪ ডিসেম্বর পাক মিলিশিয়া ও তাদের দোসরদের পরাজিত করে খোকসা উপজেলাকে হানাদার মুক্ত করতে সমর্থ হয় এলাকার মাত্র ২২ জন মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতা সংগ্রামের ৪৩ বছর পরও শহীদ ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারবর্গ উল্লেখযোগ্য সরকারী সুযোগ -সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ’৭১ সালের এপ্রিল-জুন মাসে পাক হানাদার ও তাদের দোষর রাজাকার বাহিনী ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগসহ নারকীয় অত্যাচারে খোকসা থানার সাধারণ মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। এলাকার খাগড়বাড়ীয়া, ঈশ্বরদী, একতারপুর, বেতবাড়ীয়া, দশকাহনিয়া, মানিকাটসহ প্রায় ১০ টি গ্রাম জ্বালিয়ে দেয় পাকসেনা ও রাজাকারেরা। নারকীয় হত্যাযজ্ঞ তখন নিত্যকার ঘটনায় পরিণত হয়েছিল। খোকসা থানার পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের বড়মাপের ক্যাম্প ছিল তিনটি। শোমসপুর, মোড়াগাছা ও গনেশপুর। এগুলোর মধ্যে খোকসা রেলওয়ে ষ্টেশনের পাশে শোমসপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ক্যাম্পটি ছিল সর্ববৃহৎ। এখানে সার্বক্ষনিক ভাবে ৭০/৮০ জন পাক মিলিশিয়া মোতায়েন রাখা হত। এই ক্যাম্প থেকেই ষড়যন্ত্রের নীল নকশাঁ তৈরি করা হতো। বিভিন্ন গ্রাম তল্লাশী চালিয়ে সুন্দরী যুবতীদের আটক করে শোমসপুর ক্যাম্পে আনা হত। খোকসা থানার তিনটি ক্যাম্পে মোট ৩৭৫ জন রাজাকার ও পাকসেনা ছিল বলে জানা যায়। মুক্তিযোদ্ধারা এ সময় বেশ কিছু সংখ্যক সড়ক ও রেলসেতু উড়িয়ে দিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। কয়েক দফায় আক্রমণ চালায় পাক মিলিশিয়াদের রাজাকার ক্যাম্পে। ২০ শে শ্রাবন শুক্রবার ১৩৭৮ বাংলা তারিখে গভীর রাতে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার লুৎফর রহমানের নেতৃত্বে খোকসা ও কুমারখালী থানার সীমান্তবর্তী বশিগ্রামের রাজাকার কমান্ডার খেলাফত চেয়ারম্যানের বাড়ীতে ২০/২৫ জন মুক্তিযোদ্ধা অপারেশন চালায়। কিন্তু রাজাকারদের কাছে পরাস্ত হয়ে শহীদ হয় ৫ জন অকুেতাভয় মুক্তিযোদ্ধা। আহত হয় ৮ জন। শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন ইকবাল, আনসার, গোপাল, লুৎফর, কুদ্দুস। কুষ্টিয়া-লাঙ্গলবাঁধ জি কে সেচ খালের পাশে একটি গর্ত করে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সমাহিত করা হয়। স্বাধীনতা পরবর্তী ৪৩ বছরে শুধু মাত্র ৫ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার এই গণকবরটি পাকা করনের কাজ ছাড়া তাদের যুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে সরকারী ভাবে আর কোন পদক্ষেপ নেই। বর্ষা মৌসুমের পর অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়স্থলগুলোতে পাক মিলিশিয়াাদের আক্রমণ ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। ছোটখাটো প্রতিরোধ গড়ে তোলা ছাড়া এ সময়
তেমন উল্লেখযোগ্য কোন সফলতা দেখাতে পারেনি স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা। ’৭১ সালের ২ নভেম্বর গভীর রাতে খোকসা থানা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আলাউদ্দিন খানের নেতৃত্বে রাজাকার কমান্ডার আব্দুল হাই সহ ৬ জনকে আতœসমর্পন করানো হয়। এই দিন রাতেই ২২ জন মুক্তিযোদ্ধা ৬ টি দলে বিভক্ত হয়ে খোকসা পুলিশ ষ্টেশনে আক্রমণ চালায়। ৫৫ জন পুলিশ ও ১৩০ জন রাজাকারকে আত্মসমর্পণ করিয়ে খোকসা থানা দখল করে নেয়। এখান থেকে দুই শতাধিক অস্ত্র ও বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ উদ্ধার করে। কিন্তু লোকবল স্বল্পতার কারণে ৩ ডিসেম্বর প্রত্যুষেই আতœসমর্পণকারী খোকসা থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল গনি অন্যান্যদের নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ক্যাম্প মানিকাট জিতন্দ্রনাথ দত্তের বাড়িতে চলে যায়। ঐ দিন সকাল ১০ টায় পুণরায় মিলিশিয়া ও রাজাকাররা খোকসা থানা সদরে এসে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আলাউদ্দিন খানের বসতবাড়ি মালিগ্রামে আক্রমণের পরিকল্পনা করে। মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের এই পরিকল্পনার খবর জানতে পেরে শত শত জনতাসহ প্রতিরোধের জন্য অবস্থান নেয়। মিলিশিয়া ও রাজাকাররা এই খবর জানতে পরে মালিগ্রামের দিকে আগ্রসর না হয়ে শোমসপুর ক্যাম্পে ফিরে যায়। ৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যা রাতেই মুক্তিযোদ্ধারা পুণরায় সু-সংগঠিত হয়ে খোকসা থানা ও শোমসপুর ক্যাম্প আক্রমণ করলে রাতেই পাক সেনারা শোমসপুর ক্যাম্প গুটিয়ে নিয়ে খোকসা ত্যাগ করে। পরদিন ৪ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা আনুষ্ঠানিকভাবে খোকসায় বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরও পাকিস্তানি দোসর আলবদরদের মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম অর্ন্তভূক্ত করতে একটি মহল তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। যুগ যুগ ধরে মুক্তিযোদ্ধাদের আন্তদ্বন্দের কারণে এই উপজেলার অবহেলিত ৬ টি শহীদ পরিবার সরকারী সাহায্যের নামে পেয়েছে কলা টা মুলো টা। খোকসার বীর মুক্তিযোদ্ধা নূরুল হক (৬৫) পেশায় ভ্যান চালক। ভূমিহীন এই মুক্তিযোদ্ধা বর্তমানে প্যারালাইসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে হিজলাবপ আশ্রয়ণ প্রকল্পের বিছানায় দিন কাটাচ্ছে। তার খোঁজ কেউ রাখেনি। এনিয়ে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। মুক্ত দিবস সম্পর্কে তার সাথে কথা হয়। তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর ৪৩ বছর ধরে আনুষ্ঠানিক ভাবে খোকসা মুক্ত দিবস পালন না হলেও মুক্তিযোদ্ধারা নিজস্ব উদ্দ্যোগে প্রতিবছরই এই দিনটি পালন উপলক্ষে মুক্তিযোদ্ধা সংসদে অনাড়ম্বর ভাবে মিলাদ মাহফিল ও বিশেষ প্রার্থনার ব্যবস্থা করে থাকে। খোকসা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোঃ ফজলুল হক বলেন, খোকসা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের উদ্যোগে খোকসা হানাদার মুক্ত দিবস উপলক্ষে এ বছর ৪ ডিসেম্বর সকালে পতাকা উত্তোলন, শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে মাল্যদান, বিজয় র‌্যালী, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। হানাদারমুক্ত দিবসকে আমরা আনন্দের সাথে পালন করতে চাই এবং সেভাবেই আমরা প্রস্তুতি নিয়েছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন