বৃহস্পতিবার, ফেব্রুয়ারী ১৪, ২০১৩

স্বপ্নরঙিন ভালোবাসার দিন আজ

কুদরতে খোদা সবুজ : এই দিন স্বপ্নের দিন, এই দিন স্বপ্নরঙিন। আজ বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, আজ ভালোবাসার দিন। অবশ্য, ভালো বাসাবাসি তো আর পাঁজির হিসাব ধরে নিয়ন্ত্রিত হয় না। নাকি দিনক্ষণ ঠিক করে কেউ প্রেমে পড়ে? ভালোবাসা দিবস তথা হালের ক্রেজ ‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইনস ডে’ কবে আসবে তার জন্য তো অপেক্ষা করেনি আমাদের প্রকৃতি। বসে থাকেনি আমাদের উজ্জ্বল, উচ্ছল তরুণ-তরুণীরা। কৃষ্ণচূড়া, দোপাটি আর পলাশের লালিমায় রঞ্জিত হয়ে গতকালই ভালোলাগা আর ভালোবাসার ফল্গ-ধারায় অবগাহন করতে দ্বিধা করেনি আমাদের তরুণ প্রজ. আজ খুলিয়ো হƒদয় দল খুলিয়ো,/আজি ভুলিয়ো আপনারে ভুলিয়ো/এই সঙ্গীত মুখরিত গগনে/তব গন্ধ তরঙ্গিয়া তুলিয়োঃ। ফাল্গ-ন কিংবা নববসন্তের কথা থাক, ভালোবাসার কথায় আসা যাক। আমাদের কবি মহাদেব সাহা যথার্থই বলেছেন, ‘আমরা জীবনে যা পাই না তার নাম ভালোবাসা। যে নদীর জলে মুখ ধুতে পারি না সে নদীর নাম ভালোবাসার নদী। যে ফুলের গন্ধ নিতে পারি না সেই ফুল হচ্ছে ভালোবাসার ফুল। এই ফুল ফোটে আমাদের মনে, এই নদী ফল্গ-ধারার মতো বয়ে যায় আমাদের অন্তরে। কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন জাতীয় শক্তির মূল উৎস খুঁজে পান ভালোবাসার মধ্যেই। তিনি বলেন, ‘মানুষ মানুষ হয় ভালোবেসে। মানুষ জয় করে ভালোবেসে। আমরা আমাদের ভাষার অধিকার আদায় করেছিলাম ভালোবেসে। আমাদের প্রিয় সন্তানরা ভাষা রক্ষার জন্য বুক পেতে দিয়েছিল ঘাতকের রাইফেলের সামনে কোন মন্ত্রবলে? সেই মন্ত্রের নাম ভালোবাসা। ঊনসত্তরে ভালোবেসে জেগে উঠেছিল দেশের মানুষ। একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধে তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দেশকে ভালোবেসে। ‘আমি’ এবং আমার অন্য পক্ষ ‘তুমি’. ভালোবাসার সূচনা তোমাতে-আমাতে। রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেন : ‘তুমি যে তুমিই ওগো/সেই তব ঋণ/আমি মোর প্রেম দিয়ে/শুধি চিরদিন।’ কম যান না আধুনিক কবিরাও। বনলতা সেনের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতেই তার পাখির নীড়ের মতো চোখ দুটিতে আশ্রয় খুঁজে পান জীবনানন্দ দাশ। আমাদের কবি আল মাহমুদ দিশেহারা হন সেই তুমির সুখ সাহচর্যে : ‘তুমি আমার রাত্রি, আমার অমানিশা/আমি তোমার ছোট্ট কালো জোনাক পোকা,/এইতো আলো, এইতো কালো, নেই যে দিশা/আমি তোমার রুদ্ধ দ্বারে একটি টোকা।’ কিন্তু সমকালীন নষ্ট সময়ের দংশনে কখনও নৈরাশ্যের অন্ধকারে হাবুডুব খেতে হয়। তখন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মতো স্বভাবতই উচ্চারণ করতে হয় : ‘প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য/ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা।’ আমাদের কবি শামসুর রাহমানের কণ্ঠেও ধ্বনিত হয় একই সুর : ‘ভালোবাসা তুমি অনাবৃষ্টিতে/কেমন রুক্ষ, কী দগ্ধ আজকাল।/তারা-পাতা নেই, পাখিরা উধাও;/ভীষণ রিক্ত তোমার সলাজ ডাল।’ ভালোবাসা নিয়ে এত যে কাকারখানা, এই যে রমরমা বিশ্ব ভালোবাসা দিবস তার ইতিহাসটা কী? সে কথা জানতে ফিরে যেতে হবে প্রকৃতির কাছে। ১৩৮২ খ্রিস্টাব্দে জিওফ্রে চসার ‘পার্লামেন্ট অব ফাউলস’ নামে একটি কবিতায় লেখেন : যত রকম প্রজাতির পাখির কথা মানুষ জানে সবাই জুড়ি খোঁজে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনস ডে-তে। শেকসপিয়রের ‘এ মিড সামার নাইট ড্রিম’ নাটকের একটি চরিত্রের সংলাপ, ‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন ডে তো চলে গেল, বনের পক্ষিকুল দোসর জুটিয়ে ফেলেছে।’ তারও অনেক আগে, রোমের সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস বিশাল এক সৈন্যবাহিনী গড়তে উদ্যোগী হন। কিন্তু রোমানরা পরিবার-পরিজন ছেড়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে রাজি ছিল না। সে কারণে সম্রাট ‘বিবাহ-নিষিদ্ধ’ আইন জারি করেন। সম্রাটের অযৌক্তিক আইনের প্রতিবাদ জানান ধর্মযাজক সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন। তিনি তরুণ-তরুণীদের প্রেমে উৎসাহিত করতে থাকেন। গোপনে তাদের বিয়ের ব্যবস্থাও করেন। এ কথা জানতে পেরে সম্রাট ক্লডিয়াস গ্রেফতার করেন ভ্যালেন্টাইনকে। মৃত্যুদন্ড দেয়া হয় তাকে। ভ্যালেন্টাইন যখন কারাগারে বন্দি, রাজ্যের তরুণ-তরুণীরা কারাগারে তার সঙ্গে দেখা করে তাকে উজ্জীবিত করত, ফুল দিয়ে আসত। কারারক্ষী অস্টারিয়াসের মেয়েটিও যেত তাদের সঙ্গে। মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার আগে সেই সুন্দরী মেয়েটিকে ভ্যালেন্টাইন একটি চিরকুট দিয়ে গিয়েছিলেন ১৪ ফেব্রুয়ারি তারিখে, আর সেদিনই শিরñেদ করে তাকে হত্যা করা হয়। চিরকুটে লেখা ছিল ছোট্ট একটি লাইনÑ ‘লাভ ফ্রম ইওর ভ্যালেন্টাইন!’ আর এভাবেই সময়ের আবর্তে বিশ্বময় ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’ তথা ‘ভালোবাসা দিবস’ পালনের সূচনা হয়। ইদানীং বাংলাদেশেও তার ঢেউ এসে লেগেছে। আমাদের বারো মাসে তেরো পার্বণের দেশে এটি একটি সংযোজন মাত্র। তবু ভালো, ১৪ এপ্রিলটা আমাদের বসন্তকালের একেবারে কাছঘেঁষা। সময় পাল্টে গেছে। আমাদের তরুণ প্রজš§ এখন অনেক বেশি স্বাধীনচেতা এবং পরিণামদর্শী। মূল কথাটা হল, ভালোবাসলেই ভ্যালেন্টাইন আর সেলিব্রেট করলেই ভ্যালেন্টাইনস ডে। যে কোন তারিখে যে কোন দিন। বসন্তের হাওয়া উতল হয়ে উঠা লালপেড়ে শাড়ি, লাল টিপ আর হলুদ গাঁদা ফুলের সমারোহে আজ নিশ্চয়ই তা পূর্ণতা লাভ করবে প্রাণের উষ্ণতায়, গভীর ভালোবাসায় এবং উপহার, উপাচারে। আজকের দিনে আমারও একান্ত উচ্চারণÑ ‘প্রেম যমুনায় বান ডেকেছে আজ দেব না ছাড়/তুমিই আমার সবটুকু গান মিয়াকি মালহার।’

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন